পুলিশি অভিযান থাকলেও রাজনৈতিক ও প্রভাবশালীদের আস্কায় ছিনতাই আতঙ্ক থেমে নেই


আব্দুল আলীম নোবেল: নিয়মিত পুলিশি অভিযানের পরও কক্সবাজার শহর জুড়ে এখন ছিনতাই আতঙ্ক। সামনে ঈদুল আজহা কেন্দ্র করে আরো বেড়ে যেতে পারে ছিনতাই এর ঘটনা, অনেকেই এমন আশঙ্কার কথা প্রকাশ করছেন ।

গত কয়েক বছরের কক্সবাজার শহরে ছিনতাই যেমন বেড়েছে তেমনি পুলিশি অভিযান ও মামলার সংখ্যাও বেড়েছে, তবে এইসব ছিনতাইকারী সক্রিয় থাকার পেছনে বেশ কিছু কারণ হিসেবে দেখছেন সচেতন মহল। 

স্থানীয় আধিপত্য বিস্তারে কিছু কিছু প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহল ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এইসব ছিনতাইকারীদের লালন করে থাকেন। এই তালিকায় কিছু দখলবাজসিন্ডিকেট ও গুটিকয়েক গণমাধ্যমের লোকজনেরও দেখা মিলে। পুলিশ প্রশাসন তাদের কৌশলের অজুহাতে তারাও কিছু ছিনতাইকারীদের আশ্রয় পশ্রয় দেওয়ায় এমন সুযোগে তারা আরো বেপরোয়া ভয়ংকর হয়ে ওঠে। তারা ছিনতাইকারীরা পুলিশের জালে আটকে গেলে থানা পুলিশের কাছে তদবির করেন, অপর দিকে প্রভাবশালীরা তাদের ব্যক্তিগত ফায়দা হাসিলে মামলা থেকে খালাস পেতে আদালত পর্যন্ত পৌঁছে যায় তারা। গ্রেফতার হওয়া এইসব ছিনতাইকারীদের বেশির ভাগ কিশোর গ্যাং এবং বয়সে কম ও শহরে ছিনতাইয়ের ঘটে যাওয়া ঘটনার শিকার পর্যটক ও জেলা শহরের বাহিরের লোকজন হওয়ার সুবাদে মামলা বিরুদ্ধে লড়তে বাদিরা অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়, তারা জেল থেকে বের হয়ে আবারো একই কাজে জড়িয়ে পড়ে। 

পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার পরিচয় দিয়ে গ্রাম থেকে আসা সহজ সরল মানুষদের কৌশলে ছিনতাই করে। কিছু কিছু ছিনতাইকারি দাগী আসামি ঢুকে পড়েছে আইনজীবী সহকারী ও গণমাধ্যম কর্মী পরিচয়ে, তাদের গলায় ঝুলতে দেখা যায় কিছু ভুঁইফোড় অনলাইন পত্রিকার পরিচয় পত্র। এসব অপরাধীরা কৌশলে ছিনতাইয়ের এর পাশাপাশি নানা ভাবে হয়রানি করে। তারা আবার অনেকেই কিছু নবীন প্রবীণ আইনজীবীদের সাথে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রচার করে। এই তালিকা সবার আগে উঠে এসেছে আদালত পাড়ায় প্রতিদিন ঘোরাঘুরি করা শফিক ও মোর্শেদ, জেলহাজাত থেকে কোন নতুন আসামি আসলে তারা জামিনের কথা বলে আসামির আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্ক ভালো করে অনেক সময় ছিনতাইকারীদের তাদের সম্পর্কে তথ্য দিয়ে কৌশলে টাকা পয়সা হাতিয়ে নেয়।  

কক্সবাজারে বেপরোয়া হয়ে উঠছে ছিনতাইকারী চক্র। কয়েক বছরের ব্যবধানে শহরজুড়ে ঘটেছে একের পর এক ছিনতাইয়ের ঘটনা। বেপরোয়া ছিনতাইকারীরা কখনো মোটরসাইকেল, কখনো টমটম আবার কখনো সিএনজি নিয়ে পথচারী ও যাত্রীসহ পর্যটকদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছে টাকা, মোবাইল ফোন, স্বর্ণালংকারসহ আনুষাঙ্গিক জিনিস। সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে সর্বস্ব ছিনিয়ে নিচ্ছে। কক্সবাজারে বেশ কয়েকটি ছিনতাই এর ঘটনাকে ঘিরে উদ্বেগ বেড়েছে জনমনে।

আমরা কক্সবাজার বাসি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নাজিম উদ্দীন জানান, 

ছিনতাইয়ের ঘটনা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে সাধারণ জনগণ। এক্ষেত্রে প্রশাসনকে আরো অনেক বেশি কঠোর হতে হবে। তা না হলে এটি একটি অনিরাপদ নগরী হবে। 

 রিক্সাচালক আব্দুর রহিম জানান -” মাঝেমধ্যে আমার বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যায়। তখন ভয় লাগে কখন ছিনতাইকারীরা এসে সারাদিনের কষ্টের টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যাবে।”

একজন পথচারী মিজানুর রহমান জানান – “কক্সবাজারে ছিনতাইকারী থাকবে এটা কল্পনাই করা যায় না। কারণ এটি দেশের পর্যটন এলাকা। দেশ- বিদেশের বিভিন্নস্থান থেকে পর্যটকরা এখানে আসেন। ছিনতাইয়ের ঘটনা অবশ্যই রোধ করতে হবে। ”

বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী বলেন ” ছিনতাই এর বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। এসবের কারণে কক্সবাজারের মান সম্মান চলে যাচ্ছে।ছিনতাইকারীদের উপযুক্ত শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। ”

 এ ব্যাপারে বাচিক শিল্পী এডভোকেট প্রতিভা দাশ বলেন -” ছিনতাই এর ঘটনা যখন বেড়ে যায় তখন আসলেই আমরা একটু অনিরাপদ বোধ করি। তবে আগে দেখা যেত শুধু পর্যটকদেরই ছিনতাইয়ের শিকার হত। কিন্তু এখন স্থানীয় সহ আমাদের মা বোনরাও ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছে। যেকোনো অপরাধের ক্ষেত্রে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। ”

কক্সবাজার সিটি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান শারমিন সিদ্দিকা লিমা বলেন-“পর্যটন নগরী হিসেবে আমাদের অবস্থানটা দারুন। কিন্তু নিরাপত্তার প্রশ্নে আমরা আসলেই থমকে যাচ্ছি। যখন ছিনতাই এর ঘটনাগুলো শুনি তখন মনে হয় আমি আপনি বা আমরা কেউই সুরক্ষিত নই। তাছাড়া পর্যটনবান্ধব আমরা যে কক্সবাজার শহর পাচ্ছি সেখানেও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। ”

কক্সবাজার প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম বলেন -“কক্সবাজারে ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম বেড়ে গেছে। কয়েক দিনের মধ্যেই বেশ কয়েকজন ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন। অনেকে আহত হয়েছেন। এখানে জেলা পুলিশ, টুরিস্ট পুলিশ আছে তাদের তৎপরতা আরও বাড়াতে হবে। বিশেষ করে কয়েকটি নির্দিষ্ট স্পটে লক্ষ্য করা যায় ছিনতাইয়ের ঘটনার পুণরাবৃত্তি হয়। এটি যেহেতু একটি পর্যটন শহর, এসব অপরাধমূলক ঘটনার মাধ্যমে দেশ ও বিদেশে মানুষের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছায়। কক্সবাজার একটি শান্তির শহর। অল্প কিছু পথভ্রষ্ট মানুষের জন্য কক্সবাজারের সুনাম ক্ষুন্ন হওয়া কখনোই মেনে নেওয়া সম্ভব না।”

এদিকে ছিনতাইয়ের ঘটনা প্রসঙ্গে কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম বলেন- “পুলিশ সব সময় সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। নিয়মিত অভিযান ও অব্যাহত রেখেছে, 

ছিনতাই বা অপরাধ করে কেউ পার পায়নি। সবাই ধরা পড়ছে। কঠোর অবস্থানে রয়েছেন তারা। অপরাধ করে কেউ পার পাবে না।ইতোমধ্যেই অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে অনেক ছিনতাইকারীকে । ছিনতাইকারী দমনে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। ”

ছিনতাইয়ের সব ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়না । আবার অধিকাংশ ছিনতাইয়ের ঘটনার অভিযোগ করা হয়না থানায়। যে সব ঘটনা প্রকাশিত হচ্ছে তাতেই ছিনতাইয়ের ঘটনার তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে। পুলিশ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কোন ধরনের গা ফেলে নেই। ইতিমধ্যে পুলিশ বহু ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে শাস্তির আওতায় এসেছে। তবে আগের তুলনায় ছিনতাইয়ের ঘটনা কমছে  বলে মনে করছেন তিনি। 

কক্সবাজার সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ(ওসি) মো: রকিবুজ্জামান বলেন, 

কক্সবাজার অন্য জেলা শহর থেকে ভিন্ন। এখানকার অপরাধের ধরণ ও অপরাধীদের বিচরণও অন্য রকম। এখানকার অধিকাংশ ছিনতাইকারী আইনের চোখে অপ্রাপ্ত বয়স্ক। তবুও আমরা তাদের গ্রেপ্তার করি,আদালতে পাঠাই। তারা জামিনে বেরিয়ে আসে। ফের ছিনতাই শুরু করে। আমাদের তরফ থেকে চেষ্টার কোনো কমতি নেই। 

এদিকে খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, শহরের প্রবেশদ্বার লিংকরোড়-বাস টার্মিনাল, বাইপাসসহ বিভিন্ন এলাকা পেশাদার ছিনতাইকারীদের অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণে চলে। মাঝে মাঝে  তাদের হাতে সর্বস্ব হারাচ্ছেন পর্যটক ও স্থানীয়রা।

স্থানীয়দের মতে, শহরের বাস টার্মিনাল, উত্তরণ আবাসিক এলাকা, নতুন জেলগেট, বিজিবি ক্যাম্প এলাকার আমতলা, সাবমেরিন গেট, সিটি কলেজ গেট, আলীর জাহাল রোড, গরুর হলদা সড়ক, হাশেমিয়া মাদ্রাসা গেট, খুরুশকুল রাস্তার মাথা, টেকপাড়া মসজিদ রোড়, ম্যালেরিয়া অফিস সড়ক, বার্মিজ স্কুল রোড়, বৌদ্ধমন্দির সড়ক, হাসপাতাল সড়ক, ভোলা বাবুর পেট্রোলপাম্প, লালদীঘির পাড় ও গাড়ির মাঠের মুখ, হলিডে মোড়, ৬নং মাথা, সার্কিট হাউস সড়কের ম্যাজিস্ট্রেট কলনীর সামনে, অরুনোদয় স্কুল, গোলচক্কর মাঠ, ডিসির ডাক বাংলো সড়কের মাথা, জইল্ল্যার দোকান মোড়, জাম্বুর মোড় ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মাথা ও পাশের সড়ক, লাবণী মোড়, গোলদীঘির পাড়, বাজারঘাটাসহ পৌর এলাকার ৩০টির অধিক স্থানে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে বেশি।

এ বিষয়ে ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি আপেল মাহমুদ বলেন, পর্যটকদের পাশাপাশি স্থানীয়দের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ট্যুরিস্ট পুলিশ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর জোরালো ভূমিকা করে যাচ্ছেন। সম্প্রতি অনেক ছিনতাইকারী গ্রেফতার করেছে ট্যুরিস্ট পুলিশ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ