আসহায় শিল্পী বেগম পেলেন ঘর


লালমনিরহাট জেলা প্রতিনিধিঃ
 

সুখের সংসার ছিল শিল্পী বেগমের।বাবা এক সময় ছিলেন শিক্ষা কর্মকর্তা। মাত্র সাত বছর বয়সে মাকে হারান শিল্পী বেগম। বাবার মৃত্যুর পর সৎমায়ের অত্যাচারে ঘর থেকে বের হয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। এ সময় আব্দুল কাদের নামের এক স্কুলশিক্ষক তাকে বাধা দিয়ে নিজ বাড়ি নিয়ে আসেন। এরপর অনেক কষ্টে দিন কাটে শিল্পী বেগমের।

৪০ বছর ধরে বাস করছেন লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার চওরাটারী গ্রামে একটি কুঁড়েঘরে। তার নিজ বাড়ি বগুড়া জেলার কাহালু উপজেলায়। তিনি সাবেক সহকারী থানা শিক্ষা অফিসার (এটিইও) মৃত হাবিবুর রহমানের মেয়ে। এক সময় শিল্পী বেগম বিভিন্ন প্রাথমিক স্কুলে গিয়ে গান গেয়ে শিশুদের আনন্দ দিয়ে অর্থ উপার্জন করতেন। এভাবে ৩০ বছর কেটে গেছে তার। এখন তার সেই বয়স নেই। সড়ক দুর্ঘটনায় আঘাত পেয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে যান। বর্তমানে তার দিন কাটছে অবহেলা-অযত্নে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ৫০ ছুঁই ছুঁই শিল্পী বেগম সারাদিন হেঁটে অন্যের বাড়ি গিয়ে যেটুকু চাল-ডাল পান, তাই দিয়ে চলে তার অন্নভোগ। লাঠি ভর করে চলতে হয়। অসুস্থতা আর বয়সের ভারে ন্যুব্জ শরীর নিয়ে একটি সরকারি পাকা ঘরে ঠাঁই পেয়েছেন শিল্পী বেগম। বর্তমানে পাকা ঘরে বসবাস করছেন তিনি।

শিল্পী বেগমের অসহায় অবস্থা দেখে লালমনিরহাটের আদিতমারীর সারপুকুর ইউনিয়নের তালুক হরিদাস এলাকার সাবেক প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা গিয়াস উদ্দিনের স্ত্রী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা সাইয়েদা বেগম শিল্পী বেগমের নামে দুই শতক জমি দান করেন। এরপর সারপুকুর প্রতিবন্ধী উন্নয়ন সংস্থা (অটিস্টিক) বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক রুখশানারা সুলতানা মুক্তার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘জমি আছে ঘর নেই’ প্রকল্পের আওতায় তাকে একটি পাকাঘর নির্মাণ করে দেন আদিতমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ মনছুর উদ্দিন।

জানতে চাইলে শিল্পী বেগম শুরু করলেন নিজের দুঃখ-ভারাক্রান্ত জীবনের সাতকাহন। এ সময় শিল্পী বেগমের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। দুই হাতে চোখের পানি মুছতে থাকেন আর বলেন সীমাহীন কষ্টের কথা। শিল্পী বেগম বলেন, কখনো একদিন খেয়ে চারদিন না খেয়ে ছিলাম। কষ্টে দিন কেটেছে। সাত বছর বয়সে মা মারা যান। বাবা আবার বিয়ে করেন। এরপর নবম শ্রেণি শেষ করতে না করতে বাবা এক স্কুলশিক্ষকের সঙ্গে আমার বিয়ে দেন।

বিয়ের কিছুদিন যেতে না যেতেই স্বামী অন্য এক ছাত্রীকে বিয়ে করে শিল্পী বেগমের বাড়ি ডিভোর্স লেটার পাঠান। এ খবর শুনেই বাবার হার্ড অ্যাটাকে মৃত্যু হয়। কিছুদিন না যেতেই শুরু হয় সৎমায়ের নির্মম নির্যাতন। নির্যাতন সইতে না পেরে অজানার উদ্দেশে পারি জমান শিল্পী বেগম। লালমনিরহাটের আদিতমারীর রউচব্যাগ এলাকায় ট্রেনে আত্মহত্যা করতে গেলে সেখানে থাকা এক স্কুলশিক্ষক (আব্দুল কাদের) তাকে বাধা দিয়ে মেয়ে বানিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসেন। এরপর পরিচয় মেলে শিল্পী বেগম বগুড়া কাহালু উপজেলার শিক্ষা কর্মকর্তা (এটিইও) মৃত হাবিবুর রহমানের মেয়ে।

সারপুকুর প্রতিবন্ধী উন্নয়ন সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক রুখশানারা সুলতানা মুক্তা বলেন, ‘তার এ অসহায় অবস্থা দেখে আমার মা দুইশতক জমি তার নামে দান করেন। পরে আমি আদিতমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে সরকারি একটি পাকাঘর বরাদ্দের জন্য আবেদন করি। পরে ইউএনও স্যারের মাধ্যমে তার জন্য একটি পাকাঘর নির্মিত হয়।’

তিনি আরও জানান, শিল্পী বেগমের বাবা যে প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা খোঁজ নিয়ে তার সত্যতা পাওয়া গেছে। এছাড়া তার সেই সৎমায়ের চার ছেলে ও এক মেয়ের সন্ধানও পাওয়া গেছে। তার একটি দোকান করে দেয়া হয়েছে, সমাজের বৃত্তবানরা কিছু আর্থিক সহয়তা করলে সে দোকান করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারবে।

এ বিষয়ে আদিতমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ মনছুর উদ্দিন বলেন, শারীরিক প্রতিবন্ধী ওই নারীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তার জন্য একটি পাকাঘর নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ