পদস্থ কর্মকর্তাদের নানা অপকর্মের ফিরিস্তি ২০১৯, টালমাটাল জনপ্রশাসন

বর্তমান সরকারের ধারাবাহিক তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বছর পার হচ্ছে। বছরজুড়ে নানা ঘটনায় জনপ্রশাসন ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। মাঠ প্রশাসনের পদস্থ কর্মকর্তাদের যৌন কেলেঙ্কারি গোটা প্রশাসনযন্ত্রকে তোপের মুখে ফেলেছে। যদিও এই ধরণের অপরাধ প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে হরহামেশাই ধারবাহিকভাবে চলে আসছে। পুলিশের ডিআইজি, দুদকের পরিচালক, ডিআইজি প্রিজনসহ উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাগণ আর্থিক ও কুনীতিতে জড়িয়ে প্রশাসন ও সরকারের ইমেজ নষ্ট করে দিয়েছেন। এক যুগ্মসচিবের জন্য ফেরি দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করায় দুর্ঘটনায় আহত স্কুলছাত্র তিতাসের মৃত্যুতে প্রশাসনের প্রতি সাধারণ মানুষের বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হয়েছে।
এতসব কেলেংঙ্কারির পরও জনপ্রশাসন, ভূমি প্রশাসন, খাদ্য প্রশাসনসহ বিভিন্ন পর্যায়ে গৃহীত ইতিবাচক বিভিন্ন পদক্ষেপ প্রশাসনের ভাবমূর্তি উজ্জল করেছেন। রাজউক থেকে খোয়া যাওয়া বেশ কিছু ফাইল উদ্ধার করে নজীর সৃষ্টি করেছেন গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী। পুলিশ প্রশাসনে তদবরি, নিয়োগ ও বদলী বাণিজ্য অনেকাংশে কমে এসেছে। টিআর কাবিখার টাকায় গৃহহীনদের জন্য ঘর নির্মাণ করে দেওয়ার উদ্যোগ ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। বছরের শেষ তিনমাস পেঁয়াজের মূল্য অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি এবং রাজাকারের তালিকা প্রকাশে সরকারের ইমেজ শতভাগ ক্ষুন্ন হয়েছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের পদক্ষেপে সাধারণ মানুষ অসন্তুষ্ট।
বছরের বিভিন্ন সময় মাঠ প্রশাসনে ডিসি, ইউএনওসহ কিছু কর্মকর্তার যৌন কেলেংঙ্কারি জনসম্মূখে প্রকাশ পায়। এতে প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত ধাক্কা লাগে। তদন্তে দোষী হয়েছেন তারা। তবে সরকারি চাকরি আইনের অধীনে প্রণীত আচরণ বিধির আলোকে ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া অন্য কোন ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ না থাকায় তাদের সাময়িক বরখাস্ত, ওএসডি এবং বদলী পর্যন্তই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বাদবাকি কী ব্যবস্থা নেওয়া হয় তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। পুলিশ প্রশাসনের ডিআইজি মো. মিজানুর রহমান, দুদক কর্মকর্তা এনামুল বাছির জড়িয়েছেন দূর্নীতি পাল্টা দূর্নীতিতে। ডিআইজি প্রিজন পার্থ গোপাল বনিক মোটা অংকের টাকাসহ ধরা পড়েছেন।
তারও আগে চট্রগ্রামে একজন জেল কর্মকর্তার অর্থ কেলংকারির ঘটনা ধরা পড়েন। এছাড়া বিআইডব্লিউটিএ-এর দুইজন প্রকৌশলী ঘুষের টাকাসহ গ্রেপ্তার হয়েছেন। জনপ্রশাসনে উচ্চ পদস্থ এই সব কর্মকর্তারুর্নীতি গোটা প্রশাসন সম্পর্কে সাধারণ নাগরিকদের মনে কুধারণা সৃষ্টি হয়েছে। এ সব দুর্নীতির জলন্ত জনউত্তাপের ওপর ঘি ঢেলে দিয়েছে বালিশ,পদ্মা কেনাকাটায় আর্থিক কেলেংঙ্কারির ঘটনা। সাথে যুক্ত হয়েছে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের একটি প্রকল্পে ২০০টি গাছ লাগাতে ১১ কোটি টাকা ব্যয় ধরার ঘটনা।
একজন যুগ্মসচিব ঢাকায় আসবেন এ জন্য তিন ঘন্টা মাওয়াঘাটে ফেরি আটকে দেন স্থানীয় প্রশাসন। ওই সময় ফেরিঘাটে দীর্ঘ সময় অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয় সড়ক দুর্ঘটনায় আহত কিশোর তিতাসকে বহণকারি এ্যাম্বুল্যান্সটিকে। অবশেষে ফেরি ঢাকার উদ্দেশ্যে ছাড়লেও জীবন থেকে ছুটি নেন তিতাস। ঘটনাটি বিবেকবান সকলের হৃদয়ে নাড়া দেয়। এই ঘটনায় শেষ পর্যন্ত দেশের উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করা আালত বলেছেন রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী ছাড়া দেশে কেউ ভিআইপি নন। তারা দুইজন ছাড়া সকলেই সাধারণ নাগরিক। কিন্তু কে শোনে কার কথা। বিষয়টি যে কেউ আমলেই নেন নি তা খোর জন্য অপেক্ষা করতে হবে। মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী এবং সচিবসহ বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের ৭৫ হাজার টাকা মূল্যের মোবাইল ইন্টারনেট সংযোগসহ প্রদানের বিষয়টি নিয়েও বেশ আলোচনা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বর্তমানে হারিয়ে গেলে, খোয়া গেলে উল্লিখিত ব্যক্তিদের মোবাইল সেট পুনরায় দেওয়ার বিধান সংযোজন করা হচ্ছে। রেকর্ড সংখ্যক কর্মকর্তাকে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার ফলে কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে।
প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে নানা ধরণের অনিয়ম দূর্নীতি সত্বেও প্রশাসনে বেশ কিছু ভালো কাজ হয়েছে। বিশেষ করে অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্মসচিবের পাদন্নতি নিয়ে তেমন কোন অনিয়মের অভিযোগ উঠেনি। এটা প্রশাসনের জন্য বিরাট সুখবর। এছাড়া সরকারি চাকরি আইন কার্যকর করার গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। আইন পাশের প্রায় ১১ মাসের মাথায় এই কাজটি করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে অনিয়শ্চয়তা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা কেটে গেছে। নন ক্যাডার কর্মকর্তা কর্মচারিদের পদোন্নতি, তাদের জন্য দেশে বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ জনপ্রশাসনে নতুনত্ত্ব এনেছে। নবীন সরকারি কর্মচারিদের বেতন গ্রেড অনুসারে সর্বোচ্চ ৭৫ লাখ টাকা গৃহ ঋণ প্রদানের বিষয়টিও ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে কর্মকর্তা কর্মচারিদের পেনশনের টাকা অর্ধেক নগদ প্রদান বাদবার্কি অর্থ পর্যায়ক্রমে প্রদানের সিদ্ধান্তে নিম্ন শ্রেণীর কর্মচারিরা নাখোষ ছিলেন।
স্বাধীনতার পর থেকে ভূমি প্রশাসনে হযবরল অবস্থা বিরাজ করছে। দীর্ঘ সময় পর ভূমিমন্ত্রী এবং সচিব একই মনমানসিকতার হওয়ায় গোটা ভূমি প্রশাসনের চেহারা বদলে ওেয়ার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন। বদলী, পদোন্নতি, পদায়নসক সব ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হয়েছে। সব ধরণের তদবীর বানিজ্য উৎখাত করা হয়েছে। অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্তদের চিহিৃত করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে এবং হচ্ছে। ইউনিয়ন পর্যায় থেকে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত সর্বস্তরের কর্মচারির সম্পদের হিসেবে জমা নেওয়া হয়েছে। কাউকে তিন বছরের বেশী একই স্থানে পোষ্টিং এ রাখা হচ্ছে না। সব ধরণের মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্মের লাগাম টেনে ধরা হয়েছে। অনলাইনে খতিয়ান, নামজারির ব্যবস্থা করা হয়েছে। লটারি করে কর্মকর্তাদের পোষ্টিং দেওয়া হয়েছে।
খাদ্য প্রশাসনে বদলী বানিজ্য বন্ধে নেওয়া হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। নীতিমালা করে তা কঠোরভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে। ফলে বদলী বানিজ্য অনেকাংশে কমে এসেছে। ধান চাল কেনায় বিমেষ বরাদ্দ প্রদানের নিয়ম বাতিল করা হয়েছে। ফলে অনেকাংশে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়েছে। উপরন্তু ধান চাল কেনায় বেশ কিছু সিষ্টেম ডেভেলপ করা হয়েছে। বিশেষ করে ধান কেনায় বেশী সংখ্যক কৃষক পাওয়া গেলে লটারি করে কৃষক নির্বাচন করার পদ্ধতিটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ বলে মনে করছেন অনেকই। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমে পরিবর্তন আনা হয়েছে। টিআর ও কাবিখা এবং কাবিটার টাকায় হতরিদ্রদের জন্য গৃহ নির্মাণ কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রসংশা কুড়িয়েছে। তবে গ্রামগঞ্জের কাঁচা সড়কগুলো মেরামতে বিশেষ বরাদ্দ থাকা জরুরী বলে অনেকে মনে করছেন।
/bd24live

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ