কক্সবাজার আদালত পাড়ার ভোগান্তীর শেষ কোথায়!

আব্দুল আলীম নোবেলঃ ** ভুয়া আইনজীবীর প্রতারণা ** ঘাটে ঘাটে বকশিশ ** পানি, টয়লেট-বিশ্রামাগার সংকট ** নিরাপত্তা সংকট, স্বাস্থ্যঝুকি জেলার অন্যতম বিচারালয় জেলা ও দায়রা জজ আদালত কক্সবাজার। তবে বিচার বিভাগীয় ও জেলা প্রশাসনিক স্থাপনা থাকলে এর চার পাশের অপরিষ্কার, অপরিকল্পিত। এছাড়াও নানা ভোগান্তির ভুতুড়ে চিত্র যেন বছরের পর বছর দেখতে হচ্ছে সেবা প্রার্থীদের। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ আসেন এ আদালতে। তবে নানান অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় এখানে প্রতিনিয়তই ভোগান্তিতে পড়তে হয় বিচারপ্রার্থীদের। পেশকার, জিআরও, পুলিশ, পিয়ন কম-বেশি ঘুষ ছাড়া কোনো কাজই করে না- এটা অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। এছাড়া নানা সময় ভুয়া আইনজীবীদের খপ্পরে পড়তে হয় সাধারণ বিচারপ্রার্থীদের। আদালতে নেই পর্যাপ্ত টয়লেট। আদালতে আসা মানুষের জন্য কোন পাবলিক টয়লেট নেই। এছাড়া বিচারপ্রার্থীদের জন্য নেই খাবার পানির তেমন কোনো ব্যবস্থা। নারী ও শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত বিশ্রামাগার নেই। শুধু তাই নয়, বসার জন্য এজলাস কক্ষের বাইরে নেই পর্যাপ্ত বেঞ্চও।
টাউট আইনজীবীদের প্রতারণা : অসাধু আইনজীবীদের মাধ্যমে আদালতের বিচারপ্রার্থীদের প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। এসব ভুয়া আইনজীবীদের ‘টাউট’ নামে আখ্যায়িত করে মাঝেমধ্যে একাত্তর আইনজীবী পরিষদ থেকে অভিযান চালানো হয়। তবুও থেমে নেই টাউট আইনজীবীদের প্রতারণা। আদালতে ওৎ পেতে থাকে ভুয়া আইনজীবীরা। ভুক্তভোগী পরিবার না বুঝে খপ্পরে পড়ে যান। অভিভাবকের স্বাক্ষর জালিয়াতি করেও আসামির পরিবারকে ফাঁদে ফেলে এসব অসাধুচক্র মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে, প্রতিনিয়ত আসামির পরিবারের সদস্যদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে আইনজীবী পরিচয়ধারী একশ্রেণির টাউট। মামলার ঘাটে ঘাটে বকশিস : মামলা হওয়ার পর এজাহারের কপির জন্য গুনতে হয় আনুমানিক ২শ থেকে ৭০০ টাকা, জামিনের পিটিশনে পেশকার ৫শ আর জিআও ৭শ, বেইল বন্ড পেশকার ৭শ আর জিআরও ৫শ থেকে ১ হাজার, নথি উপস্থাপনে পেশকার ২শ, আর এলসি তলব ১ হাজার, অভিযোগের কপি ৫শ,সইমরি নকল প্রতিপর্দ ৫০ টাকা যদি দ্রুত নিলে ১০০ টাকা, হাজিরা পিটিশন ৭০ টাকা, সময়ের দরখাস্ত ১০০ টাকা, সেরেস্তা থেকে মামলা জেলখানায় বেইল বন্ড পাঠাতে ৫শ থেকে দেড় হাজার টাকা আর রোহিঙ্গা হলে ৫ হাজার টাকাও নেওয়ার অভিযোগ তুলছেন, নাজির এল এস পীট ৫০ থেকে ১শ টাকা, উচ্চ আদালতের জামিন নামা সতর্কীকরণ স্টেনোগ্রাফী জামিন নামা সম্পাদনে ১ হাজার থেকে দেড় হাজার নেওয়ার অভিযোগ তুলছেন ভুক্তভোগীরা। এইসব টাকা না দিলে কাজ হয় না বলে জানান আইনজীবীরা। চার্জশিটের কপি নেয়া থেকে শুরু করে মামলার কাজে যেকোনো নথি নিতে গেলে আদালতের জিআরও, পেশকারদের বকশিস দিতে হয়। আদালতের প্রচলিত নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে। সবার সামনেই দেদারসে নেয়া হয় এই বকশিস। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিচারপ্রার্থীদের কাছ থেকে বখশিশের নামে টাকা নিয়ে আইনজীবী নথি দেন। আসামি আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে নিয়জিত পুলিশকেও বকশিস দিতে হয়। এছাড়া আসামিকে খাবার পৌঁছে দিতে, আসামিদের সঙ্গে কথা বলতে হলেও পুলিশকে বকশিস দিতে হয় স্বজনদের। পানি, টয়লেট-বিশ্রামাগার সংকট : আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থী মিলে আনুমানিক প্রদিতিন ১০-২০ হাজার মানুষ আদালত প্রাঙ্গণে এলেও নেই পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা ও পর্যাপ্ত টয়লেট সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এদিকে পুরো কোর্ট এলাকায় নেই সিসি ক্যামেরা। ফলে ছিনতাইকারীসহ অস্ত্র নিয়ে যে কেউ চাইলেই আদালত প্রাঙ্গণে ঢুকতে পারে। তাই গুরুত্বপূর্ণ বড় মামলায় সাক্ষী দিতে একপ্রকার ঝুঁকি নিয়েই আসতে হয় বিচারপ্রার্থীদের। নানা সময় এমন অভিযোগ আদালতে করতে দেখা যায় তাদের। যে কোনো সময় অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটতে পারে বলেও আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। ময়লার ভাগাড় : এছাড়া আদালত চত্বরের বিভিন্ন জায়গায় আবর্জনার স্তূপে দুর্গন্ধের সঙ্গে গড়ে উঠেছে মশার অভয়ারণ্য। ময়লা-আবর্জনা ফেলা হলেও তা দেখার কেউ নেই। এ ছাড়া অন্য আদালত ভবনগুলোর চারপাশে রয়েছে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। নেই পর্যাপ্ত পার্কিং ব্যবস্থা : এছাড়া আদালত প্রাঙ্গণে নেই পর্যাপ্ত পার্কিংয়ের জায়গা। এতে বিচার পেতে আদালতে গাড়ি নিয়ে এলে বড় রকমের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতি সভাপতি এডভোকেট সিরাজুল ইসলাম বলেন, টাকার অংক এত না হলে স্টাফ ছাড়া কিছু লোকজন কাজ করে হয়তো তাদের জন্য এই টাকা নিচ্ছে তারা। কোর্টে পেশকার বা পিওনদের বকশিস দেয়া অলিখিত বিষয়। অনেকে খুশি হয়ে দেয়। ব্রিটিশ সময় থেকে এটা চলে আসছে। তবে কেউ যদি চেয়ে বা জোর করে নেয় সেটা অন্যায়। সর্বোপরি আইনজীবী সমিতি, কোর্ট প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সমন্বিত উদ্যোগ নিলে প্রতারণাসহ অন্যান্য সমস্যার সমাধান করে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি কমানো সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। কোর্ট পুলিশ পরিদর্শক মো. মাসদুর রহমান বলেন, টাকার বিনিময়ে আসামিদের খাবার দেয়া বা দেখা করার সুযোগ আমাদের কোর্টে নেই। আসামি আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে নিরাপত্তাও জোরদার রয়েছে। ৭১ আইনজীবী পরিষদের সভাপতি এডভোকেট হারেছ রহমান বলেন, এখানে অন্ধের দেশে চশমা বিক্রির মতো, যার ফলে সাধারণ বিচার প্রার্থীরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। এডভোকেট মোঃ ফয়সাল জানান, প্রতিদিনই বিচারপ্রার্থী, আইনজীবী ও সংশ্লিষ্টদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়। আইনজীবী সমিতি, কোর্ট প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সমন্বিত উদ্যোগ নিলে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি কমানো সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। রাষ্ট্র পক্ষের আইনজীবী পিপি অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম বলেন, আইন অঙ্গনে অনিয়ম দুর্নীতির সহ্য করা হবে না, কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড় দেয়া হবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ