করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতে কারও কাছে হাত না পেতে পান সিগারেট বিক্রি করে পরিবারের খরচ যোগাচ্ছে শিশু মোহিত


মিজানুর রহমান মিলন স্টাফ রিপোর্টারঃ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতেও কারও কাছে হাত না পেতে পান সিগারেট বিক্রি করে পরিবারের খরচ যোগাচ্ছে শিশু মোহিত। ভ্রাম্যমাণ দোকানের সামান্য আয় দিয়েই দু মুঠো খেতে পারছে তাঁর  বাবা মা একমাত্র ছোটবোন। মোহিতের বাড়ি সৈয়দপুর শহরের রসুলপুর এলাকার  পাওয়ার হাউসের পিছনে।
ওই এলাকার একটি ছোট্ট ঝুপড়ি ঘরে তাদের বসবাস। তাঁর বাবার নাম জাহাঙ্গীর আলম (৩৪) মায়ের নাম মনি বেগম (২৮) বাবা মায়ের বড় সন্তান সে। ঘরে রয়েছে মিজাব নামে আড়াই বছরের আদরের ছোট বোন। তাঁর বাবা পেশায় সেলাই কারিগর (দর্জি) মা মনি বেগম গৃহিনী। গতকাল শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে শহরের শহীদ ডা. জিকরুল হক সড়কের পাঁচমাথা মোড়ে দেখা হয় তাঁর সাথে। সেখানে ছোট্ট একটি ফলের ঝুঁড়িকে পানের ডালা বানিয়ে গলায় ঝুঁলিয়ে ক্রেতার অপেক্ষায় দাড়িয়ে ছিল সে। শহরে লোক সমাগম তেমন নেই করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির কারণে। তারপরেও বাবা মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে দাড়িয়ে আছে সে। মাঝে মাঝে দু একজন ক্রেতা এসে তাঁর কাছ থেকে পান সিগারেটও নিচ্ছে। তখন কৌতুহল বশত কথা হয় তাঁর সাথে। প্রথমে সে কথা বলতে না চাইলেও মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতেই স্নেহের পরশ পেয়ে সে একটু স্বাভাবিক হয়। তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয় তাঁর পরিবারের কথা এবং সে কেন পান সিগারেট বিক্রি করছে। মোহিত জানায়, তাঁর বাবা জাহাঙ্গীর সেলাই কারিগর। টেইলার্স দোকানে কাজ করে সংসার চালাতেন। কিন্তু মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে যায় তাঁর বাবা। শহরের কাদেরিয়া তাহেরিয়া সাবেরিয়া  সুন্নিয়া মাদরাসায় চতুর্থ শ্রেনী পর্যন্ত পড়া মোহিত জানায়, তাঁর বাবা অসুস্থ্য হয়ে পড়ায় অর্থাভাবে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায় তাঁর। আর তখন থেকেই তাদের সংসারে নেমে আসে অভাব নামক যন্ত্রনা। ছোট বোন মিজাবের কান্নাও সহ্য হয়না তাঁর। আর তখনি মা মনি বেগমের মাধ্যমে ওই এলাকার পরিচিত একজনের পরামর্শে শহীদ ডা. শামসুল হক সড়কে অবস্থিত একটি কাপড়ের দোকানে কর্মচারি হিসেবে কাজ শুরু করে সে। সপ্তাহে ৬০০ টাকা পারিশ্রমিক  হিসেবে কাজ করে আসছিল মোহিত। বেশ কিছুদিন ওই দোকানে কাজ করা অবস্থায় তাদের সংসার কোনমতে চলে যেত। কিন্তু সে অবস্থা বেশিদিন চলেনি। গত মার্চ মাসে শুরু হলো করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতা।সারাদেশের মত সৈয়দপুরেও শুরু হলো লকডাউন। আর পরিস্থিতিতে ব্যবসা বাণিজ্যে ধ্বস নামায় মোহিতের দোকান মালিক মার্চের শেষ সপ্তাহের পারিশ্রমিক দিয়ে তাঁকে বিদায় করে দেয়। এরপরেই মোহিতের শুরু হয় নতুন করে বেঁচে থাকার সংগ্রাম। বর্তমানে করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতে বিভিন্ন সময়ে বেশ কিছু খাদ্য সহায়তা পেলেও সংসারের অন্যান্য প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে পান সিগারেট বিক্রি শুরু করে সে। মোহিত জানায়, তাঁর মা সামান্য টাকা ধার করে পাশের বাড়ি থেকে ছোট্ট একটি প্লাস্টিকের ফলের ঝুঁড়িকে পানের ডালা বানিয়ে সামান্য পান দুই প্যাকেট সিগারেট কিনে দেয়। তখন থেকে সে,শহরে পান সিগারেট বিক্রি করে আসছে।সে,জানায় কারও কাছে হাত না পেতে প্রায় দেড় মাস থেকে ব্যবসা শুরু করেছে। প্রতিদিন বিকেল ৫টার দিকে বাড়ি থেকে পানের ডালা নিয়ে বের হয় সে। থাকে রাত ১০/-১১ টা পর্যন্ত। সে জানায় লকডাউনের কারণে সন্ধ্যার পর মানুষজনের চলাচল কম থাকায় বেচাকেনা তেমন একটা হয়না। তবে তারাবিহ নামাজ শেষে মানুষজনের চলাচল একটু বাড়লে বেচাকেনা ভাল হয়। তারপরেও সাড়ে শত/ শত টাকার বেশী বিক্রি হয়না। এতে তাঁর ৮০ থেকে ১০০ টাকা লাভ হয়। আর তা দিয়েই কোনমতে সংসার চালাতে হচ্ছে। এসময় মোহিত কান্নাজড়িত কন্ঠে জানায়, কয়েকদিন আগে শহরের মুন্সিপাড়া মোড়ে পান সিগারেটের দোকান নিয়ে গেলে এক মাদকসেবি তাঁর কাছ থেকে জোর করে দুই প্যাকেট গোল্ডলিফ সিগারেট ছিনিয়ে পালিয়ে যায়। ফলে পুঁজি হারিয়ে কান্নাকাটি করলে এক মুরুব্বি তাঁকে সিগারেট বাঁকিতে কিনে দেয়। আর তখন থেকে আবার ব্যবসা চালিয়ে আসছে সে। ভ্রাম্যমাণ পান সিগারেট বিক্রেতা শিশু মোহিতের সাথে কথা বলার সময় উপস্থিত ছিলেন অনেকেই। শিশুটির কথা শুনে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক তাঁর জন্য কিছু সহায়তার ব্যবস্থা করবেন বলে জানান তিনি। এদিকে সৈয়দপুরে মোহিতের মতো অনেক শিশু এখন সংসারের বোঝা টানতে লেবু, কলাসহ অন্যান্য পন্য বেচাকেনা করছে। মানবিক বিবেচনায় তাদের দায়িত্ব কে নেবে। প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ