নাজমুল
হাসান,বিশেষ প্রতিবেদক
নানা অনিয়ম আর দুর্নীতিতে জর্জরিত হয়ে পড়েছে নাটোরের একমাত্র টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজ। অনুমোদনহীন কোর্স ও কোচিং পরিচালনা, আবাসিক কোয়ার্টারে অবৈধভাবে বসবাস করার সুযোগ প্রদান, প্রতিষ্ঠানের ফ্রিজ নিজ কোয়ার্টারে ব্যবহার, টিচিং স্টাফ না হওয়া সত্বেও লাইব্রেরীয়ানকে ক্লাশের দায়িত্ব প্রদান, অভ্যন্তরীন ও বোর্ড পরীক্ষার ডিউটি প্রদান, জাতীয় সংগীত না হওয়াসহ নানা অভিযোগ বর্তমান অধ্যক্ষ কলিম উদ্দিন ও তার কয়েকজন সহযোগী শিক্ষকদের বিরুদ্ধে। ইতিমধ্যে অনিয়মের প্রতিকার চেয়ে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর বরাবর অভিযোগ দিয়েছে স্থানীয় একজন। অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় নাটোর টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজ। প্রথমে যুবাদের বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে এটি ভোকেশনাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রুপান্তর করে এসএসসি পর্যন্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। সম্প্রতি এখানে খোলা হয়েছে ডিপ্লোমা কোর্স। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই অত্যন্ত সুনামের সাথে পথ চলছিল প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু ২০১৭ সালে বর্তমান অধ্যক্ষ কলিম উদ্দিন যোগদানের পর থেকেই বেহাল দশা বিরাজ করতে থাকে। অধ্যক্ষ ও তার সহযোগী কতিপয় শিক্ষকের অনিয়ম আর দূর্নীতির কবলে পড়ে নাটোর টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজ। ফলে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। সরকারী নির্দেশ অনুযায়ী সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার বিধান রয়েছে। অভিযোগ আছে, কলিম উদ্দিন অধ্যক্ষ হিসাবে যোগদানের পর থেকে একদিনের জন্যও জাতীয় সংগীত হয়নি প্রতিষ্ঠানটিতে। তার প্রত্যক্ষ মদদে কতিপয় শিক্ষক বেপরোয়া হয়ে উঠে। ক্লাসে পড়ানো বাদ দিয়ে কোচিং করতে বাধ্য করে শিক্ষার্থীদের। অথচ কোচিং বাণিজ্য বন্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও কারিগরী শিক্ষা অধিদপ্তরের নির্দেশনা রয়েছে। সেই নিয়মের তোয়াক্কা না করে রসায়নের ইন্সট্রাকটর ফেরদাউস নেওয়াজ, গণিতের ইন্সট্রাকটর মোঃ শামসুজ্জোহা ও পলাশ চন্দ্র প্রামানিক, পদার্থের ইন্সট্রাকটর আজিজুল ইসলাম শিক্ষার্থীদের নিয়মিত প্রাইভেট পড়ান। এমনকি প্রতিষ্ঠানে ক্লাস চলাকালেও প্রাইভেট পড়ান হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীরা মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং প্রাইভেট পড়তে বাধ্য হচ্ছে। এতে অধিকাংশ হতদরিদ্র শিক্ষার্থী প্রাইভেটে অতিরিক্ত ফি পরিশোধ করতে গিয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। কোন শিক্ষকের কাছে কতজন শিক্ষার্থী কখন প্রাইভেট পড়ে এমন একটি তালিকা গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে থাকলেও তা অস্বীকার করেন অভিযুক্ত শিক্ষকরা। অনিয়মে সহযোগিতার পুরস্কার স্বরূপ টিচিং স্টাফ না হওয়া সত্বেও লাইব্রেরীয়ানকে ক্লাশ নেওয়ার দায়িত্ব, অভ্যন্তরীন ও বোর্ড পরীক্ষার ডিউটি প্রদান এবং আবাসিক কোয়ার্টারে অবৈধভাবে বসবাস করার সুযোগ করে দেওয়া হয়। সরেজমিনে গিয়ে অভিযোগগুলোর সত্যতাও মেলে। এছাড়া ইলেকাট্রক্যাল বিভাগের ইন্সট্রাকটর কে.এম মাহফুজুর রহমান এবং অটোমোবাইল বিভাগের ইন্সট্রাকটর সামায়ন হোসেন সহ কতিপয় কর্মকর্তা ‘সরকারী বাসায় বসবাস করেন না’ মর্মে প্রত্যয়ন দিয়ে বাড়ি ভাড়া উত্তোলন করেন। কিন্তু বাস্তবে তারা প্রতিষ্ঠানের অফিস সহায়কের নামে কম ভাড়ায় বাসা বরাদ্দ নিয়ে অবৈধভাবে সেসব কোয়ার্টারে দীর্ঘদিন যাবৎ বসবাস করে আসছেন। সেই সাথে সরকারী বিদ্যুৎ, পানিসহ যাবতীয় সুবিধা ভোগ করছেন। কোন প্রকার তদন্তের আভাস পেলে সুকৌশলে কোয়ার্টার থেতে সটকে পড়েন এবং সমস্যা মিটে গেলে পুনরায় বসবাস শুরু করেন। প্রতিষ্ঠানের প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড কর্মকর্তা অটোমোবাইলের ইন্সট্রাকটর সামায়ন হোসেন দীর্ঘ প্রায় ১৪ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত থাকার কারণে প্রতিষ্ঠানের ভিতরে ও বাইরে প্রভাব বিস্তার করেছেন। তিনি সরকারী কর্মচারী বিধিমালা ভঙ্গ করে অবৈধভাবে প্রতিষ্ঠানের ভিতরে ও বাইরে ‘নীড় ডিজাইন’ নামে বিল্ডিং ডিজাইনের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ ব্যাপারে তার কৈফিয়ৎ হচ্ছে তিনি ওই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কনসালট্যান্ট মাত্র। সম্প্রতি নাটোর টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ কেন্দ্রে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং বোর্ড সমাপনী পরীক্ষা চলাকালে কেন্দ্রের মধ্যে ব্যক্তিস্বার্থে অনুমোদনহীন কোর্স পরিচালনার ঘটনাও ঘটেছে। ইলেকট্রিক্যাল বিভাগের ইন্সট্রাকটর কে.এম মাহফুজুর রহমান পরীক্ষা কেন্দ্রে দায়িত্বরত থাকাকালে বিকেল ৩টা থেকে ৫ টা পর্যন্ত কারিগরী শিক্ষা অধিদপ্তর ও বোর্ডের কোন অনুমোদন না নিয়ে পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির ইলেকট্রিশিয়ানদের একটি কোর্স পরিচালনা করেছেন। পরীক্ষা কেন্দ্র ১৪৪ ধারা জারি থাকা সত্বেও বহিরাগত প্রশিক্ষণার্থীগনের
প্রবেশের
কারণে
বোর্ড
পরীক্ষার
গোপনীয়তা
ও
নিরাপত্তা
বিঘিœত করেছেন। অটোমোবাইল ট্রেডের কাঁচামাল ও খুচরা যন্ত্রাংশ খাত হতে ক্রয়কুত ওয়ালটন রেফ্রিজারেটর, মাল্টিমিডিয়া ক্লাশের জন্য ক্রয়কৃত ডেল ব্র্যান্ডের একাধিক ল্যাপটপ সহ গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা উপকরণ অধ্যক্ষ এবং ইন্সট্রাকটর রসায়ন তাঁদের বাসভবনে ব্যবহার করছেন। কারিগরী শিক্ষা অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী ওয়েবসাইট খোলার নামে অর্থ ব্যয় করা হলেও মেইন ডোমেইনে প্রতিষ্ঠানের কোন ওয়েবসাইট খোলা হয়নি। ফলে সেবা প্রর্থীরা অনলাইন সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের বায়োমেট্রিক হাজিরা বাবদ অর্থ আদায় করা হলেও আজও বায়োমেট্রিক হাজিরা চালু করা হয়নি। অভিভাবক দিবস পালন না করায় তাদের সাথ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। এ সকল কারণে ওই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ভর্তি ও ক্লাশে উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র ৮০০জন। এ ধরণের আরও অনিয়ম ও দূর্নীতির কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির দিন দিন অবনতি ঘটছে। অভিযোগের বিষয়ে ইলেকাট্রক্যাল বিভাগের ইন্সট্রাকটর কে এম মাহফুজুর রহমান বলেন, অধ্যক্ষ স্যারের নির্দেশনা মোতাবেক ইলেকট্রিশিয়ানদের একটি কোর্স পরিচালনা করেছি। বোর্ড পরীক্ষার সময়ে অবৈধ কোর্স পরিচালনা কেন করলেন এমন প্রশ্নের কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি। লাইব্রেরিয়ান মোছাঃ নুরুন্নাহার বলেন, অধ্যক্ষ স্যার কোয়ার্টারে বসবাসের সুযোগ করে দিয়েছেন। তিনিই ক্লাশের দায়িত্ব প্রদান, অভ্যন্তরীন ও বোর্ড পরীক্ষার ডিউটি প্রদান করেন। আমি তার নির্দেশ মোতাবেক কাজ করি। প্রতিষ্ঠানটিক ব্যবহারিক পরীক্ষার ফ্রিজ কোথায় আছে তার জবাব নেই দায়িত্বরত সপ ইনচার্জ সুব্রত চন্দ্র জায়দারের কাছেও। অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নাটোর টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ কলিম উদ্দিন জানান, নিয়মিত জাতীয় সংগীত হয়। শুধু পরিক্ষার সময় হয়না। এছাড়া তার জানা মতে কোন কোচিং বাণিজ্য হয় না। তার অগোচরে কেউ কোচিং করাতে পারে। প্রতিষ্ঠানটির ফ্রিজ কোথায় আছে সেটা তার জানা নেই। এছাড়া কোয়ার্টারে বসবাস ও লাইব্রেরিয়ানকে ক্লাস ও বোর্ড পরীক্ষায় ডিউটির সুযোগ প্রদানের বিষয়ে কোনও সুদুত্তর দেননি তিনি । নাটোরের জেলা প্রশাসক মোঃ শাহরিয়াজ বলেন, তিনি নাটোর টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজের অনিয়মের বিষয়টি অবগত হয়েছেন। অনিয়ম খতিয়ে দেখে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করা হবে বলে জানান তিনি ।
0 মন্তব্যসমূহ