নিউজ ডেস্কঃ
কখনও র্যাব, কখনও ডিবি আবার কখনও পুলিশের পোশাক পরে ছিনতাই করতো একটি চক্র। নিজেদের সোর্সের মাধ্যমে টার্গেট ব্যক্তি চিহ্নিত করতো। তারপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাক পরে চালাতো ভুয়া অভিযান। দিন-দুপুরেই বাসাবাড়ি, ব্যাংক ও যানবাহন থেকে টার্গেট করা ব্যক্তিকে নামিয়ে দিতো। এরপর টাকাপয়সা নিয়ে মারধর করে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়া হতো তাদের। কারও কাছে নগদ টাকা না থাকলে চেকও নিয়ে নিতো তারা। শুধু রাজধানীতেই নয়, চক্রের সদস্যরা এই অপরাধ করে বেড়াতো সারাদেশেই। এই সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রের নেতৃত্বে রয়েছেন খোদ ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। একটি মামলার তদন্ত করতে গিয়ে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই।
পিবিআই সূত্রে জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাক পরে ডাকাতি-ছিনতাই করা এই সংঘবদ্ধ চক্রের মূল হোতা ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সুব্রত হালদার বাপ্পী। তার অন্যতম দুই সেকেন্ড ইন কমান্ড হলো- মেহেদী হাসান ও আশিক পারভেজ। তারা দু’জনও ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কর্মী। এই চক্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত আরও কয়েকজনের নাম পেয়েছে পিবিআই। এদের মধ্যে ইমরান, সজীব, রাকিব ও ইউসুফ উল্লেখযোগ্য। ইমরান ও সজীবও ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কর্মী ও বাপ্পীর অনুসারী বলে পিবিআই কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
পিবিআই’র ঢাকা মেট্রো প্রধান বিশেষ পুলিশ সুপার বশীর আহমেদ বলেন, ‘আমরা তদন্তে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য পাচ্ছি। তদন্ত চলছে। অন্য আসামিদের ধরতে অভিযান চালানো হচ্ছে। এই চক্রটি অনেক জায়গায় ডাকাতি ও ছিনতাই করেছে। আমরা প্রত্যেকটি বিষয়ই খতিয়ে দেখছি।’
পিবিআই সূত্র জানায়, গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর রাজধানীর শনিরআখড়া এলাকায় মাহামুদুল হাসান নামে এক ব্যক্তিকে র্যাব পরিচয়ে অস্ত্রের মুখে বাস থেকে নামিয়ে নেয় এই সংঘবদ্ধ চক্রটি। তবে ঘটনার সময় কয়েকজন উবার চালক তাদের চ্যালেঞ্চ করলে র্যাব পরিচয়ধারী দুর্বৃত্তরা তাদের ব্যবহৃত প্রাইভেটকার ও আইডি কার্ড ফেলে তিন লাখ টাকা ও মোবাইল সেট নিয়ে পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে মাহামুদুল হাসান যাত্রাবাড়ী থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলাটি থানা পুলিশের পর পিবিআই তদন্ত শুরু করে।
পিবিআই কর্মকর্তারা জানান, মামলার তদন্ত করতে গিয়ে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে তারা ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কর্মী মেহেদী হাসান ও আশিক পারভেজকে গ্রেফতার করে। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গত বুধবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর দারুস সালাম থেকে জাহাঙ্গীর আলম ওরফে স্বাধীন ও কলেজ গেট এলাকা থেকে আলমগীর খাঁকে গ্রেফতার করে। এদের মধ্যে মেহেদী হাসান ছাড়া বাকি তিন জনই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তিন জনই তাদের জবানবন্দিতে র্যাবর পোশাকে টাকা লুটের ওই ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের আহ্বায়ক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক সুব্রত হালদার বাপ্পী বলে উল্লেখ করেন।
মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট পিবিআই’র একজন কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মামলাটি তদন্ত করতে গিয়ে আমরা অবাক হচ্ছি। সংঘবদ্ধ এই গ্রুপটির নেটওয়ার্ক সারাদেশে বিস্তৃত। বিভিন্ন অপরাধ জগতের সবাই একসঙ্গে মিলিত হয়ে বিভিন্ন বাহিনীর পরিচয়ে ডাকাতি-ছিনতাই করে। এখন পর্যন্ত এই গ্রুপের ১৫ সদস্যের নাম পাওয়া গেছে। এই গ্রুপে আরও লোকজন রয়েছে। এরা ছিনতাই করার সময় প্রতি গ্রুপে থাকে ৮ থেকে ৯ জন। তাদের হাতে থাকে ওয়াকিটকি, ডিবি, র্যাব বা পুলিশের ইউনিফর্ম। থাকে প্রাইভেটকার অথবা মাইক্রোবাস এবং আগ্নেয়াস্ত্র। তারা ব্যাংক, যানবাহন, ফুটপাত ও বাসা থেকে লোকজনকে তুলে নিয়ে টাকা আদায় করে।’
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) পুলিশ পরিদর্শক কামাল হোসেন বলেন, ‘আটক আসামিরা একটি সংঘবদ্ধ ডাকাত ও ছিনতাইকারী দলের সদস্য। তারা কখনও র্যাব, কখনও ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে ঢাকা মহানগরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রথমে অপহরণ ও পরে ডাকাতি করে সর্বস্ব লুটে নেয়। তারা সোর্সের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ব্যবসায়ীদের বড় অঙ্কের নগদ টাকার লেনদেন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে। পরে টাকাপয়সা নিয়ে যাওয়ার সময় অনুসরণ করে। পথে কোনও এক জায়গা থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে তাদের কাছে অবৈধ জিনিস আছে বলে আটক করে এবং তাদের নির্ধারিত মাইক্রোবাসে করে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে নিরিবিলি ও সুবিধাজনক স্থানে নিয়ে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে মারধর করে ব্যবসায়ীদের কাছে থাকা টাকাপয়সা ও মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে যায়।’
পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘ডাকাতি করতে তারা সাধারণত মাইক্রোবাস ও প্রাইভেটকার ভাড়া নেয়। কাজ শেষে গাড়ি জমা দিয়ে চলে যায়। তারা নিশ্চিত না হয়ে কোনও অপারেশন করে না। নিজেদের মধ্যে সিনিয়র ও জুনিয়র কমান্ড মেনে চলে। এমনকি নিজেদের মধ্যে কেউ পুলিশকে তথ্য দিয়ে দিচ্ছে কিনা তাও ভালোভাবে যাচাই করে নেয়।’
জেলখানায় পরিচয়, সারাদেশে ডাকাতি-ছিনতাই
জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতাররা জানিয়েছে, এই চক্রের সদস্যদের মধ্যে একে অপরের সঙ্গে জেলখানায় পরিচয় হয়। গ্রেফতারদের মধ্যে আলমগীরের বিরুদ্ধে তিনটি, স্বাধীনের বিরুদ্ধে তিনটি, মেহেদীর বিরুদ্ধে দুটি ও আশিকের বিরুদ্ধে একটি মামলা রয়েছে। এছাড়া পলাতক আসামি ইউসুফের বিরুদ্ধে তিনটি ও রাকিবের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা রয়েছে।
২০১৫ সালে স্বাধীন কলাবাগান থানা এলাকায় এক ব্যক্তির কাছ থেকে একই কায়দায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে আটক করে নগদ টাকা না পেয়ে চেক নেয়। সেই চেক দিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করতে গিয়ে পুলিশের কাছে গ্রেফতার হয়েছিল।
পিবিআই কর্মকর্তারা বলছেন, এই চক্রটি ঢাকার বাইরে সাভার, বগুড়া, জামালপুর, গাজীপুর, বরিশাল, চট্টগ্রাম এলাকাতেও একই কায়দায় ডাকাতি ও ছিনতাই করেছে বলে স্বীকার করেছে।
২০১৬ সালে সংঘবদ্ধ এই চক্রটি রাজধানীর ডেমরা এলাকা থেকে জাহাঙ্গীর নামে এক ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে তিন কোটি টাকা দাবি করে। এক নারী মাদক ব্যবসায়ীর দেওয়া তথ্যমতে জাহাঙ্গীরকে অপহরণ করা হয়। ওই ব্যবসায়ী এত টাকা দিতে না পারায় তাকে হত্যা করে বলে পিবিআই কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। ওই ঘটনার সঙ্গে সরাসরি পথিক ও ইউসুফ নামে এই চক্রের দুই সদস্য জড়িত ছিল। ওই ঘটনাটিও নতুন করে অনুসন্ধান করছে পিবিআই।
এ ব্যাপারে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাপ্পীর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগের প্রমাণ পেলে অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নেবো। আমি শুনেছি তার এলাকার এক ছেলে ডাকাতি নাকি কোনও একটি ঘটনায় যুক্ত ছিল, আর ওই ছেলের বাড়ি বাপ্পীর এলাকায়, এটা কি তার অপরাধ হতে পারে ? তবে, তার বিরুদ্ধে যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযোগ প্রমাণ করতে পারে, তাহলে অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নেবো। বাপ্পী আমাকে বললো যে সে ওই ঘটনায় জড়িত নয়।’
/বাংলা ট্রিবিউন।
0 মন্তব্যসমূহ