চকরিয়া আ. লীগের সাধারণ সম্পাদক গিয়াসের বেপরোয়া কুকর্ম

দলের ক্ষমতাকে পুঁজি করে অবৈধ পন্থায় ১০ বছরে বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছেন কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন। তাঁর বিরুদ্ধে সংরক্ষিত বনাঞ্চল উজাড়, পাহাড় সাবাড় করে মাটি বিক্রি, বনের গাছ নিধন, বনের ভেতর ইটভাটা স্থাপন, সামাজিক বনায়নের গাছ নিধন করে ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার, পাথর উত্তোলন, পাহাড়ি বিভিন্ন ছড়া, মাতামুহুরী নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনসহ পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। বন উজাড়ের অভিযোগে গিয়াসের বিরুদ্ধে মামলা হলে আদালত তাঁকে ছয় মাসের কারাদণ্ড এবং অর্থ জরিমানাও করেন।

গিয়াসের বিরুদ্ধে আরো ভয়াবহ অভিযোগ হচ্ছে, অবৈধভাবে কবজায়  নেওয়া ৭৭ শতাংশ জমি দখলে রাখতে দিগরপানখালীর শিক্ষক নারায়ণ দাশ হত্যাকাণ্ডে মদদদান এবং মামলার বাদীসহ পুরো পরিবারকে ভারতে চলে যেতে বাধ্য করা। সাবেক পৌর কাউন্সিলর লক্ষ্মণ কান্তি দাশকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা, তাঁর মাটি কাটার একটি এক্সকাভেটর পেট্রল দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া এবং তাঁর পৈতৃক বাড়ির চারদিকের মাটি কেটে পুকুর করারও অভিযোগ রয়েছে গিয়াসের বিরুদ্ধে।

গিয়াস যাতায়াতে ব্যবহার করেন কোটি টাকা দামের প্রাডো গাড়ি। পরিবারের জন্য রয়েছে আরো দুটি পাজেরো জিপ, যে দুটির রেজিস্ট্রেশন বা রুট পারমিট নেই।

কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধান এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা জানা গেছে, আশির দশকে গিয়াসের পরিবার ছিল একেবারে নিম্নবিত্ত। তখন গিয়াস গাছ-বাঁশের ব্যবসা করতেন। বান্দরবানের লামা উপজেলার পাহাড়ি ঝিরি-ছড়া থেকে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের কারণে গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক তৈরীকৃত পাথরখেকোর তালিকায় নাম ওঠে তাঁর। দরিদ্র নুরুল কবিরের ছেলে গিয়াস শুরু করেন জাসদের রাজনীতি। নব্বইয়ের দশকে জাসদ ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে প্রথমে হন ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের সভাপতি। এর পর থেকে উপজেলা কমিটিতে কখনো যুগ্ম আহ্বায়ক, আহ্বায়ক, সর্বশেষ সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন।

ফাঁসিয়াখালীর সংরক্ষিত বনাঞ্চল উজাড় ও বন্য হাতির অভয়ারণ্য ধ্বংস করার ঘটনায় বন বিভাগ মামলা করলে উপজেলা জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালত গিয়াসকে ছয় মাসের কারাদণ্ডাদেশ এবং ১০ হাজার টাকার অর্থদণ্ড দেন। এর পরও থেমে থাকেনি তাঁর পরিবেশবিধ্বংসী কর্মকাণ্ড। প্রতিনিয়ত উচিতারবিল ও আশপাশের পাহাড় কেটে সেই মাটি বাইরে বিক্রি এবং নিজের ইটভাটায় ব্যবহার করে আসছেন। সংরক্ষিত বনভূমির বহু একর জায়গাও দখলে রাখার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। পৌর শহর চিরিঙ্গায় শ্যালক কাউন্সিলর মুজিবুল হকের সঙ্গে যৌথ মালিকানায় গড়ে তুলছেন বাণিজ্যিক মার্কেট। নামে-বেনামে রয়েছে বহু একর চিংড়ি জমি। রয়েছে দুটি আলিশান বাড়ি, অনেকগুলো মিনিট্রাক ও ডাম্পার গাড়ি। বড় ছেলের নামে বাণিজ্যিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আইয়ুব ফিলিং স্টেশন, ছোট ছেলের নামে আপন কমিউনিটি সেন্টার। ব্যবসা করেন কক্সবাজার, বান্দরবানের বিভিন্ন বন রেঞ্জের গাছের লট নিলাম নিয়ে। বাড়ি ফাঁসিয়াখালীর পুকপুকুরিয়ায় হলেও পাশের ইউনিয়ন ডুলাহাজারার ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে কোটি টাকার লট নিলাম হাতিয়েছেন। সরকারকে কর ফাঁকি দিতে তিনি ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করেছেন। অবৈধভাবে অর্জিত অনেক সহায়-সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন বিগত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য নির্বাচন কমিশনে দাখিলকৃত হলফনামায়।

ফাঁসিয়াখালী বন রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘এর আগে যাঁরা আমার স্থলাভিষিক্ত ছিলেন, তাঁরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বিভিন্ন প্রতিবেদন দিয়ে গেছেন। সেসব প্রতিবেদনে ফাঁসিয়াখালী সংরক্ষিত বনাঞ্চল উজাড়ের নেপথ্যে গিয়াসের নাম রয়েছে।’ তিনি বলেন, বন বিভাগের স্বল্পসংখ্যক জনবল নিয়ে প্রভাবশালীদের সঙ্গে পেরে ওঠা সম্ভব হয়ে ওঠে না।

কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক লায়ন কমরুদ্দীন আহমদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অনেক দিন থেকে শুনছি, গিয়াস উদ্দিন সংরক্ষিত বন ধ্বংস করছেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ নিয়ে বসে আছেন শুধু পরিবেশবিধ্বংসী এসব কর্মকাণ্ড চালাতে। গিয়াসের মতো তাঁর চার ভাইও যেন বনের মধ্যে রাজত্ব কায়েম করেছেন। এতে তাঁরা রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক বনেছেন। এসব পরিবেশবিধ্বংসী অপতৎপরতা বন্ধ করা জরুরি।’

সংখ্যালঘু নির্যাতন, শিক্ষক নারায়ণ হত্যাকাণ্ডে মদদদান, মামলার বাদীসহ পরিবারকে দেশান্তরে বাধ্য করার অভিযোগ : পৌরসভার দিগরপানখালীর প্রফুল্ল কুমার দাশ ওরফে সাঁচিরামের পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত ৭৭ শতাংশ জায়গা রয়েছে ফাঁসিয়াখালীর রাজারবিল মৌজার ডেইলপাড়ায়। সেই জায়গা গিয়াসের ভাই ও আত্মীয়-স্বজন দখলে নেয়। প্রফুল্ল কুমার আদালতের দ্বারস্থ হন। মামলার সব কিছু দেখাশোনা করছিলেন তাঁর বড় ছেলে শরীরচর্চা শিক্ষক নারায়ণ দাশ। এ অবস্থায় ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা ২০১৪ সালের ১৯ অক্টোবর ভোররাতে বাড়িতে ঢুকে শিক্ষক নারায়ণকে ঘুমন্ত অবস্থায় গুলি করে হত্যা করে।এ সময় তাঁর বৃদ্ধ মা-বাবা ও ছোট ভাই জয়শঙ্কর আহত হন। এ ঘটনায় জয়শঙ্কর বাদী হয়ে থানায় মামলা করলেও গিয়াসের প্রভাবে সেই মামলা হিমাগারে। মামলায় গিয়াসকে সরাসরি আসামি করতে না পারলেও স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে তাঁর দিকেই ইঙ্গিত করেন মামলার বাদীসহ পুরো পরিবার। মামলাটি বর্তমানে সিআইডি পুলিশ তদন্ত করছে।

জয়শঙ্কর দাশের অভিযোগ, পৈতৃক সম্পত্তি জবরদখলে রাখতে তাঁর ভাই নারায়ণকে গুলি করে হত্যায় মদদ দেন গিয়াস উদ্দিন। কিন্তু তিনি সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতা হওয়ায় তাঁকে আসামি করতে পারেননি। যাঁদের আসামি করা হয়েছিল, তাদেরও পুলিশ ওই সময় গ্রেপ্তার করতে না পারায় প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে তাঁরা নিজ বাড়ি ছেড়ে পৌর শহরে ভাড়া বাসায় ওঠেন। সেখানেও থাকতে না পেরে তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আগরতলায় নিকটাত্মীয়ের বাড়িতে চলে যান।

নারায়ণের বোনজামাই শিক্ষক রূপন কান্তি দে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গিয়াস উদ্দিন চেয়ারম্যানের ভাইসহ তাঁর লোকজন প্রতিনিয়ত মামলা তুলে নিতে হুমকি দিয়ে আসছিলেন বাদীকে। পরিবারের সদস্যদের নারায়ণের মতো একই পরিণতি ভোগ করার হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। এই অবস্থায় আমার বুড়ো শ্বশুর-শাশুড়ি, মামলার বাদীসহ (শ্যালক) পরিবারের সদস্যরা প্রাণ রক্ষার্থে ভিটাবাড়ি ছেড়ে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হন।’

উপজেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি রতন বরণ দাশ কালের কণ্ঠকে জানান, শিক্ষক নারায়ণ দের পৈতৃক সম্পত্তি জবরদখলে রাখেন গিয়াসের ভাই-স্বজনরা। বিয়ের ১০ দিন আগে নারায়ণকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপর মামলার বাদী, তাঁর মা-বাবাসহ পরিবার সদস্যদের হুমকি দেওয়া চলতে থাকে।

আরেক ভুক্তভোগী হচ্ছেন সাবেক পৌর কাউন্সিলর লক্ষ্মণ কান্তি দাশ। ঘুনিয়া মৌজায় তাঁদের পৈতৃক সম্পত্তি অবৈধভাবে দখলে রাখতে তাঁকেও গুলি করে হত্যার চেষ্টা হয়। সশস্ত্র সন্ত্রাসী দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হয় তাঁকে। এ সময় তাঁর প্রায় ৩০ লাখ টাকা মূল্যের এক্সকাভেটর পেট্রল দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এমনকি দিগরপানখালী গ্রামে লক্ষ্মণের পৈতৃক বাড়ির চারদিকের মাটি কেটে পুকুর খনন করেন গিয়াস। এ ঘটনায় লক্ষ্মণ কান্তি আদালতে গিয়াসের বিরুদ্ধে মামলা করলেও সেই মামলা গতি পায়নি গিয়াসের প্রভাবের কারণে। এ নিয়ে নতুন করে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি লক্ষ্মণ কান্তি দাশ।

গিয়াসের ব্যবহৃত দুটি গাড়ির রেজিস্ট্রেশন ও রুট পারমিট না থাকা প্রসঙ্গে কক্সবাজারে কর্মরত একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট জানিয়েছেন, তিনি এই দুটি গাড়ির রেজিস্ট্রেশন করতে পারবেন না। কারণ গাড়ি দুটি তিনি লট নিলামে ক্রয় করেছেন পার্টস বিক্রির শর্তে। কিন্তু তা না করে নিজে এবং পরিবার সদস্যরা ব্যবহার করছেন।

আরো সব অভিযোগ : ভুক্তভোগীরা বলেছেন, এলাকায় কেউ নতুন বাড়ি করতে চাইলে গিয়াসের ইটভাটার নিম্নমানের ইট এবং তাঁর ভাইদের কাছ থেকে বালু কিনতে বাধ্য করা হয়। কেউ বাড়ি টেকসইভাবে নির্মাণ করতে অন্য কোথাও থেকে ইট আনলে তা সড়কের মধ্যে আটকে দেওয়া হয়। এতে এক প্রকার বাধ্য হয়েই নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে তৈরি করতে হয় বাড়ি।

কক্সবাজার জেলা, উপজেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, আওয়ামী লীগের রাজনীতির অন্যতম আদর্শ হচ্ছে অসাম্প্রদায়িকতা। কিন্তু গিয়াস উদ্দিন লালন করেন সাম্প্রদায়িকতা ও দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি। শিক্ষক নারায়ণ হত্যাকাণ্ড এবং এই মামলার বাদিসহ তাঁর পুরো পরিবারের দেশান্তরি হওয়ার পেছনে গিয়াসের হাত রয়েছে বলে এলাকায় প্রচার রয়েছে।

এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে গিয়াস উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি ৩০ বছর ধরে দলের রাজনীতিতে যুক্ত। ১৭ বছর ধরে জনপ্রতিনিধি। জনগণ আমাকে বারবার ভোট দিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেছেন। বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় আমি বেশ নির্যাতিত হই। বন উজাড়ের কোনো মামলা বা অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে নেই। আমার ইটভাটারও লাইসেন্স রয়েছে। ইটভাটার আশপাশে কোনো পাহাড় নেই এবং পাহাড় সাবাড়েরও কোনো ঘটনা ঘটেনি। সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগও সত্য নয়।’

ডুলাহাজারার ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার প্রসঙ্গে গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘একসময় আমি কাঠের ব্যবসা করলেও এখন করি না। তবে সামাজিক বনায়নের লট নিলামে অংশ নিতে অনেকে আমার ফার্মের লাইসেন্স ব্যবহার করে।’
/কালের কন্ঠ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ