কক্সবাজারের সুগন্ধা পয়েন্ট জুড়ে পর্যটকদের আকর্ষণীয় শুটকির বিশাল সমহার

এম আলমঃ
কক্সবাজাররের পর্যটন এলাকার সুগন্ধা ডলপিন মার্কেট ও বৃহত্তর শুটকি মার্কেট জুড়ে রয়েছে ভোজন প্রিয়দের পছন্দনীয় ও আকর্ষণীয় রকমারী শুটকি। এই শুটকি শুধু দেশেই নয় তার গণ্ডী পেরিয়ে বিদেশেও বিপুলসংখ্যক মানুষের কাছে জনপ্রিয়।  আর এই শিল্পকে ঘিরে শুটকি তৈরি ও ব্যবসার সাথে জড়িত শিক্ষিত, অর্ধ শিক্ষিত ও কর্মমুখি প্রায় লক্ষধিক মানুষ। আবার অনেকে বিভিন্ন বেসরকারী এনজিও সংস্থা ও ব্যাংক লোণ নিয়েও এ ব্যবসা সম্প্রসারণ করে চলছে সুগন্ধা পয়েন্ট জুড়ে।

বাংলাদেশে উৎপাদিত শুটকির একটি বড় অংশ উৎপাদন হয় কক্সবাজারে। আগে কক্সবাজারে বেশ কয়েকটি শুটকির গ্রাম ছিল। কিছু দরিদ্র মানুষ শুটকি তৈরি ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত ছিল। এখন শুটকি উৎপাদন হয় বাণিজ্যিকভাবে, বিশাল কলেবরে। কক্সবাজারে শুটকি শুকানোর সবচেয়ে বড় মহাল কক্সবাজার শহর সংলগ্ন পশ্চিম সাগরের তীরে নাজিরারটেক। বিশাল সমুদ্র উপকূলে যে কয়েকশত একর জায়গা নিয়ে অবস্থিত এ রকম একটা শুটকিপল্লী হতে ‍পারে, তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। সেখানে দেখা যাবে আদি-অন্তের সব রহস্য। দেখা মিলবে নারীরা কিভাবে একের পর এক শুটকি বেছে বেছে তা রোদে শুকানোর উপযোগী করছে। পুরো এলাকার বাতাসে শুটকির ঘ্রাণ।

এটি নতুন চরএলাকা। বছরজুড়ে এখানে চলে শুটকি মাছের উৎপাদন। প্রায় শত একরের বিশাল এলাকাজুড়ে শত শত বাঁশের মাচায় নানা জাতের মাছ শুকানো হয়। এছাড়াও কক্সবাজার জেলার উপকূলীয় এলাকা মহেশখালীর সোনাদিয়া, গোরকঘাটা, তাজিয়াকাটা, কুতুবজোম, কুতুবদিয়া উপজেলার বড়ঘোপ, খুদিয়ারটেক, আলী আকবর ডেইল, অংজাখালী, পশ্চিম ধুরুং, টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, সেন্টমার্টিন, জালিয়াপাড়া, সদর উপজেলার নাজিবারটেক, খুরুশকুল, সমিতিপাড়া, চৌফলদণ্ডিসহ বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকা থেকে উৎপাদিত শুটকি সরবরাহ করা হয় সুগন্ধা পয়েন্ট এর শুটকী দোকান গুলোতে। এসব শুটকির মধ্যে রয়েছে সামুদ্রিক রূপচাঁদা, ছুরি লাক্কা, কোরাল, সুরমা, লইট্যা, চিংড়ি এবং মিঠাপানির মাছের মধ্যে শোল, কাচকি, কুচো চিংড়ি, মলা, গইন্যা, বাইলা, ফাইস্যাসহ প্রায় ২০ প্রজাতির মাছ। প্রতিনিয়ত দেশি-বিদেশি পর্যটকরা এসব দোকান থেকে শুটকি সংগ্রহ করে।

কক্সবাজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এসএম খালেকুজ্জামান বলেন, আগামী মার্চ-এপ্রিলে যে জাটকা অভিযান চলবে, এটাকে যদি সঠিকভাবে বজায় রাখতে পারি তাহলে শুটকি উৎপাদন ব্যাপক হারে অব্যাহত থাকবে।

নাজিরারটেক মৎস্য ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি আতিক উল্লাহ বলেন, দেশের এ বৃহৎ শুঁটকি মহালে দিন দিন উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত বছরের তুলনায় এবার অর্ধশত শুঁটকি ব্যবসায়ী বেড়েছে। বেড়েছে শ্রমিকের সংখ্যাও। গত বছর প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক থাকলেও এবারে তা ৩৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।

দূর দূরান্ত থেকে আগত পর্যটকদের সাথে আলাপে জানা যায়, তাদের কাছে খুবই মজার ও আকর্ষণীয় এক খাবার শুটকি।  আগে দামে সস্তা থাকায় শুটকিকে গরীবের খাবার হিসেবে তাচ্ছিল্য করা হতো। কিন্তু এখন শুটকির দামের বৃদ্ধির পাশাপাশি বদলেছে অবস্থানও। এখন শুটকি দেশের ধনীদের অন্যতম নিয়মিত একটি খাবার মেন্যু। এমনকি দেশের বিভিন্ন নামী-দামি রেস্টুরেন্ট সহ বিলাসবহুল ‍হোটেলেও শুটকির উপস্থিতি দেখা যায়।

ময়মনসিং থেকে আগত পর্যটক ঐশি জানান, ইতিপূর্বে কক্সবাজারে ভ্রমণে এসে সুগন্ধা পয়েন্ট এর সুন্দরবন শুটকি বিতান থেকে পছন্দের শুটকি নিয়ে বাসায় রান্না করে খাওয়ার পর অসাধারণ স্বাদ পেয়েছে। এইজন্য এবারও পরিবারের জন্য তার পছন্দের শুটকি ক্রয় করতে এসেছেন।

ঢাকা থেকে আগত পর্যটক শাহাদাত হোসেন শাহীন, কুমিল্লা থেকে রাফসান মাহমুদ, নাটুর থেকে শরীফ ও গাজীপুর থেকে আগত পর্যটক মিম আক্তার জানান, কক্সবাজারের শুটকি আসলেই খুব সু-স্বাদু। যতবারই কক্সবাজারে আসেন ততবারই পরিবার পরিজনদের জন্য সুগন্ধা পয়েন্টের সৈকত শুটকী আড়ৎ থেকে শুটকি ক্রয় করে থাকে।

সুগন্ধা পয়েন্ট এর সৈকত শুটকী আড়ৎ এর মালিক ব্যবসায়ী শামশুল আলম জানান, পর্যটন মৌসুমে আমাদের ব্যবসা ভালো হয়। দামের ক্ষেত্রে প্রতি কেজি ৩০০ টাকা থেকে শুরু করে ৩ হাজার টাকার দামে মাছ রয়েছে। কোন ক্যামিকেল ছাড়াই শুটকি ক্রেতাদের তুলে দিতে পারলে ভালো লাগে।

সুগন্ধা পয়েন্ট এর সুন্দরবন শুটকি বিতানের মালিক ব্যবসায়ী হাজী মফিজ উল্লাহ বলেন, আগে কীটনাশক ব্যবহার করা হলেও এখন তারা মাছ ভালোভাবে শুকিয়ে পলিথিনের প্যাকেটে সংরক্ষণ করেন। ফলে শুটকির মান ভালো থাকে এবং নষ্ট হয় না। এতে পর্যটকেরা সন্তুষ্ট হয়ে মোবাইলে ফোনে যোগাযোগ করেও কুরিয়ারে পাঠানোর জন্য অর্ডার করে।

কক্সবাজারের সুগন্ধা সিন পয়েন্ট এর বৃহত্তর শুটকি মার্কেট ও সুগন্ধা ডলফিন মার্কেট সমিতির সভাপতি আবদুর রহমান জানান, শুটকি রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পর ৭২-৭৩ সালে শুটকি রপ্তানি থেকে যেখানে সরকারের আয় হতো ১৭ হাজার ৯০০ টাকা, সেখানে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের চাহিদা মিটিয়ে শুটকি রপ্তানি ‍করে আয় হয়েছে ৪০০ কোটি টাকা। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় ৬২৩ মেট্রিক টন শুঁটকি বিদেশে রপ্তানি করা হয় (২০১৭-১৮ অর্থবছরে হিসাব) দেশে ৮-১০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ বাণিজ্যিকভাবে শুঁটকি করা হয়।

সুগন্ধা ডলফিন মার্কেট সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজী জসিম উদ্দিন ও সদস্য নজরুল ইসলাম বলেন, যারা ভ্রমণপিপাসু কক্সবাজারে আসেন একটু কষ্ট হলেও ওই শুটকি পল্লী দেখে আসা উচিত। দেশের মধ্যে কি এক যজ্ঞ হচ্ছে তা ‍না দেখলে অনেক মজা ও শেখা অপূর্ণ থেকে যাবে। সুগন্ধা সড়কের উভয় পাশে বিভিন্ন শুটকি, সি-ফুড, আচার, ঝিনুক ও খাবারের রেস্টুরেন্ট সহ রকমারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থাকায় পর্যটকেরা সুগন্ধা সড়কেই ভিড় জমায় এবং সার্বক্ষিণ এই সড়কটিতে ট্যুরিস্ট পুলিশের সার্বিক নিরাপত্তার চাঁদরে ও বিদ্যুতিক আলোতে আলোকিত থাকায় পর্যটকেরা নির্ভিঘ্নে চলাফেরাতে নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দবোধ মনে করেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ