নাটোরের এক মাতবরের কথাই ‘আইন’


সিংড়া প্রতিনিধি
নাটোরের সিংড়ায় একটি হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ছয় সহোদরের প্রায় দেড়শত বিঘা জমিতে চাষাবাদে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন এক ইউপি মেম্বার। স্থানীয় গ্রাম মাতবরদের নির্দেশের নামে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে তাদের জমিতে চাষাবাদ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে ওই ছয় ভাইয়ের পরিবার মানবেতর জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে।
জানা গেছে, ডাহিয়া ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার কামাল হোসেনের নেতৃত্বে তার সমর্থকরা মামলায় অভিযুক্তদের জমি আট মাস ধরে চাষাবাদ করতে দিচ্ছে না। জমিজমা নিয়ে বিরোধের জেরে গত জানুয়ারিতে দু’পক্ষের সংঘর্ষে নিহত হন কামালের বড় ভাই আলমগীর। এই হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ছয় ভাই জামিন পেলেও ইউপি সদস্য তাদের বাড়ি ফিরতে দিচ্ছেন না। এর আগে হত্যাকাণ্ডের পর ছয় ভাইয়ের বাড়িঘরে লুটপাট করা হয়।
তবে ইউপি সদস্য কামাল হোসেন বলেছেন, তিনি কোনো নির্দেশ দেননি। গ্রাম মাতবরদের নির্দেশ পেয়ে তারা নিজেরাই জমি চাষ বন্ধ রেখেছেন। এখানে মাতবরদের নির্দেশই আইন বলে জানান তিনি। তার দাবি, গ্রাম মাতবররা তার ভাই হত্যার প্রতিশোধ নিতে এ নির্দেশ দেননি; বরং অভিযুক্তদের দখলে থাকা কবরস্থানের জমি ফেরত দিতে বাধ্য করতেই এ ব্যবস্থা।
এলাকাবাসী ও ভুক্তভোগী পরিবার সূত্রে জানা যায়, ডাহিয়া ইউনিয়নের ছোট বাঁশবাড়িয়া এলাকার ইউপি সদস্য কামালের সঙ্গে প্রতিবেশী মৃত তমিজ উদ্দিনের ছয় ছেলের জমি নিয়ে বিরোধ দীর্ঘদিনের। এর জেরে গত ১৮ জানুয়ারিতে উভয় পরিবারের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে কামালের বড় ভাই আলমগীর নিহত হন। এই হত্যা মামলায় ছয় ভাইসহ ৩০ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। ছয় ভাইয়ের জমিতে চাষাবাদে নিষেধাজ্ঞা জারির পর তারা বোরো ও আমন মৌসুমে ফসল ফলাতে পারেননি। স্থানীয় প্রশাসনের কাছে লিখিতভাবে জানিয়েও প্রতিকার পাচ্ছেন না।
গত রোববার ওই এলাকায় গেলে ছয় ভাইয়ের পরিত্যক্ত বাড়িগুলোতে লুটপাটের চিহ্ন দেখা যায়। তবে কামাল সমর্থকদের ভয়ে এলাকার কেউ কথা বলতে চান না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন জানান, ঘটনার পর থেকে কামাল মেম্বারের লোকজন তমিজ উদ্দিনের ছেলেদের গ্রামে ফিরতে দিচ্ছে না। তবে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে অন্য আসামিদের গ্রামে ফিরতে এবং চাষাবাদের সুযোগ দিয়েছে। কামাল তার সমর্থক গ্রাম মাতবরদের দিয়ে ওই ছয় ভাইয়ের বিরুদ্ধে কবরস্থানের জমি দখলের অভিযোগ তুলেছেন।
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক আনিছুর রহমান বলেন, একটি হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে আট মাস ধরে পরিবারগুলো গ্রামছাড়া। দুটি মৌসুম ধরে অনাবাদি রয়েছে বিলের দেড়শ’ বিঘা ধানি জমি। লুটে নেওয়া হয়েছে ৯টি শ্যালো মেশিন, মোটর ও পুকুরের মাছ।
কৃষক লাবু মিয়ার স্ত্রী শাহানাজ বেগম বলেন, কামাল মেম্বারের তাণ্ডবে এলাকার কেউ কথা বলার সাহস পায় না। তাদের ছেলেমেয়ে ও পরিবারের লোকদের একঘরে করে রাখা হয়েছে। তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
কামাল সমর্থক মাতবরদের দাবি, তমিজ উদ্দিনের সন্তানরা গ্রামের কবরস্থানের জায়গা দখল করায় তাদের জমি চাষ করতে দেওয়া হয়নি। মাতবর মিজানুর রহমান বলেন, তমিজের ছেলেরা এলাকার কবরস্থানের প্রায় দুই একর জায়গা দখলে নিয়ে পুকুর করেছে। একসময় তাদের অত্যাচারে গ্রামের মানুষ অতিষ্ঠ ছিল। তার এক ছেলে মাদ্রাসা শিক্ষক হলেও নানা অনৈতিক কাজে জড়িত। অনেকেই তমিজের স্বজনদের অপকর্ম ও নির্যাতনের শিকার। ওই ছয় পরিবারের পেছনে এখন কেউ নেই। সবার সিদ্ধান্ত, তারা কবরস্থানের জমি ফেরত না দিলে জমি চাষ করতে পারবে না।
মিজানুর আরও বলেন, আলমগীর হত্যা মামলা আইন অনুযায়ী চলবে। তবে তমিজের ছেলেদের গ্রামে ঢুকতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ সঠিক নয়। তারা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বিশেষ ব্যক্তিদের সহানুভূতি পাওয়ার চেষ্টা করছে।
আলমগীর হত্যা মামলার অভিযুক্ত ও মৃত তমিজ উদ্দিনের ছেলে অধ্যাপক আবদুস সালাম বলেন, কামাল মেম্বার ও তার সমর্থকদের হুমকির মুখে আট মাস ধরে তারা দুই শতাধিক বিঘা জমিতে চাষ করতে পারছেন না। গত ২৭ আগস্ট এর প্রতিকার চেয়ে সিংড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পুলিশ সুপারের কাছে আবেদন করেছেন। তবে এখন পর্যন্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পুলিশ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। তবে সিংড়া থানার ওসি মনিরুল ইসলাম বলেন, জমিতে আবাদ করতে না পারার বিষয়টি সম্পর্কে তিনি অবগত নন। তিনি খবর নিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন।
সিংড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুশান্ত কুমার মাহাতো বলেন, আবেদনটি তার নজরে আসেনি। তবে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি হয়েও একজন ইউপি সদস্যের এমন আচরণ মেনে নেওয়া যায় না। কোনো মামলা থাকলে আদালত দেখবে, পুলিশ দেখবে। কিন্তু শতাধিক বিঘা জমি অনাবাদি থাকাটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। বিষয়টি খতিয়ে দেখে দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান তিনি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ