তৃতীয় দফার সাক্ষ্য: সিনহাকে লাথি ও গলা চেপে ধরেন ওসি প্রদীপ

 


বিশেষ প্রতিবেদক

কক্সবাজারের টেকনাফে মেজর (অব.) সিনহা হত্যা মামলার আনুষ্ঠানিক বিচারকার্যের তৃতীয় দফার ১ম দিনে তিনজনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়েছে। তারা হলেন মো. আবদুল হামিদ, ফিরোজ মাহমুদ, শওকত আলী । সার্জেন্ট মো. আয়ুব আলী আদালতে উপস্থিত থাকলেও সময় স্বল্পতার কারণে তার সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়নি। আজ মঙ্গলবার (২১ সেপ্টেম্বর) তার সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে আদালত সূত্র জানিয়েছে।

সোমবার (২০ সেপ্টেম্বর) ১০টা ২০ মিনিটে আবদুল হামিদের সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্যে দিয়ে সিনহার হত্যা মামলার তৃতীয় দফার দফার বিচার কার্য শুরু হয়। সাক্ষীতে আবদুল হামিদ বলেন: পরপর কয়েকটি গুলির আওয়াজ শুনে আমি ঘটনাস্থলে যাই। গিয়ে দেখি লিয়াকত স্যার মোবাইল বের করে কাউকে ফোন করেন। এই সময় তিনি দুজনকে হ্যান্ডকাপ লাগান। নন্দ দুলাল গুলি খাওয়া লোকটিকে হ্যান্ডকাপ লাগান। লম্বা চুলোয়ালা লোকটির পাশে গিয়ে শাহজাহান আলীকে লোকটিকে হ্যান্ডকাপ লাগাতে বলেন। শাহজাহান আলী বলেন হ্যান্ডকাপ নাই। তখনি এপিবিএন সদস্য দৌড়ে বাজারে গিয়ে রশি নিয়ে আসেন। নন্দ দুলাল, রাজিব ও আবদুল্লাহ মিলে লম্বা চুলওয়ালা লোকটিকে শক্ত করে বাধেন।

এরপর লিয়াকত স্যার ফোন করে বলেন: টার্গেট ফেলে দিয়েছি। ‘ আবার ফোন করে বলেন, ‘স্যার একজনকে ডাউন করেছি, আরেক জনকে ধরে ফেলেছি স্যার। লিয়াকত গুলি খাওয়া লোকটির কাছে গিয়ে রাগ করে কি যেন বলে লাথি মারেন। লোকটি পানি চায়। তখন লিয়াকত স্যার বলে তোকে গুলি করেছি কি পানি খাওয়ানোর জন্য।

কিছুক্ষণ পর পুলিশ ফাঁড়ির দিক থেকে আরও চারজন অস্ত্রসহ পুলিশ- লিটন, সাফানূর, কামাল ও ক্যাশিয়ার মামুন ঘটনাস্থলে আসেন। ঐ চারজন অস্ত্র উচু করে লোকজনকে নির্দেশ দেন কেউ সামনে আসবেন না। গুলি খাওয়া লোকটিকে কোন সাহায্য করবেন না। লিয়াকত স্যার মামুন ও সাফানূরকে প্রাইভেট কার তল্লাশি করতে বলেন। প্রাইভেট কার তল্লাশি করে একজন পুলিশ চিৎকার করে বলেন: ‘পেয়েছি,গাড়ির ভেতরে পিস্তল ও কিছু কাগজপত্র পেয়েছি।’

এসময় দক্ষিণ দিক থেকে একটি নোহা আরেকটি পুলিশের পিকআপ গাড়ি নিয়ে ওসি প্রদীপ স্যার আসে। তিনি গাড়ি থেকে নেমে ঘটনাস্থলে গিয়ে লিয়াকত স্যার, নন্দুলাল স্যার এর সাথে কানেকানে কিছু কথা বলেন। ওসি প্রদীপ স্যার সেনাবাহিনীর মতো পোশাক পরা লোকটির কাছে গিয়ে রাগ করে বলেন,’ অনেক চেষ্টার পর কুত্তার বাচ্চাকে শেষ করতে পেরেছি।’ মানুষটি তখন জীবিত ছিল। ওসি প্রদীপ স্যার গুলি খাওয়া লোকটির বাম পাশে কয়েকটি লাথি মারেন এবং পা দিয়ে গলার উপর চেপে ধরেন। ওসি প্রদীপের পায়ে বুট জুতা ছিল। কিছুক্ষণ পর মানুষটির নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায়। ওসি প্রদীপ স্যারের সাথে আসা পুলিশদের প্রাইভেট কার তল্লাশি করতে বলেন। প্রদীপ স্যারের কথায় সাগর ও রুবেল যাদের নাম প্রদীপ সারের ডাকাডাকিতে জানতে পারি তারা প্রাইভেট কারে এসে বলেন ইয়াবা ও গাজা পেয়েছি স্যার।

প্রদীপ স্যার ও লিয়াকত স্যার গাড়ির আড়ালে গিয়ে কিছু কথা বলেন। প্রদীপ স্যার প্রাইভেট কারের কাছে আসেন এবং লম্বা চুলওয়ালা লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বলেন,’ তোরা কিসের ভিডিও করেছিস? ক্রসফায়ারের ভিডিও করেছো, এগুলো কোথায়? তোদেরকে কক্সবাজার ছেড়ে চলে যেতে বলছিলাম। যাও নাই বলে তোদের আজকে এই পরিণতি হয়েছে।’ সাগর ও রুবেল অন্যান্য পুলিশ লম্বা চুলওয়ালা লোকটিকে এপিবিএন চেকপোস্টের ভেতরে ঢুকাইয়া চোখে গামছা বেধে পানি ঢালেন।

তার দেয়া সাক্ষ্যের সাথে একমত পোষণ করেন সোমবারের অপর দুই সাক্ষী ফিরোজ মাহমুদ ও শওকত আলীও । আদালতে সিনহা হত্যার এমনই বিবরণ দিয়েছেন তিন সাক্ষী বলে জানিয়েছেন বিচারকাজের সাথে জড়িত একাধিক আইনজীবী।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারী কৌঁসুলি ফরিদুল আলম বলেন, তৃতীয় দফার সাক্ষ্য গ্রহণ চলবে ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। প্রথমদিনে তিনজন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহন ও জেরা সম্পন্ন হয়েছে।

আদালত সূত্র জানায়, অন্য দিনের মতো গতকাল সোমবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে মামলার আসামি সাবেক ওসি প্রদীপ, পরিদর্শক লিয়াকতসহ ১৫ আসামিকে কারাগার হতে আদালতে আনা হয়।

আদালতে উপস্থিত আসামিরা হলেন বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, পরিদর্শক লিয়াকত আলী, কনস্টেল রুবেল শর্মা, এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুল করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া ও কনস্টেবল সাগর দেব নাথ। আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) সদস্য এসআই মো. শাহজাহান, কনস্টেবল মো. রাজিব ও মো. আব্দুল্লাহ এবং টেকনাফের বাহারছড়ার মারিষবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা ও পুলিশের করা মামলার সাক্ষী নুরল আমিন, মো. নিজাম উদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ