লালমনিরহাটের জেগে উঠা ৬৩ চরে এখন সবুজের সমারোহ


হাসানুজ্জামান হাসান,লালমনিরহাটঃ 

কয়েক মাস আগের ব্যাপক বৃষ্টিপাত ও উজানের ঢলে লালমনিরহাটের ৫ উপজেলায় দেখা দেয় ভয়াভয় বন্যা। একদিকে বন্যা অন্যদিকে করোনায় তছনছ হয়ে গেছে পাঁচটি উপজেলার ১০ হাজার মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। ভেসে গেছে ঘর, নদীগর্ভে গেছে ভিটেমাটি, পানিতে ডুবে নষ্ট হয়েছে ফসল। কাজ না থাকায় অর্ধাহারে-অনাহারে কাটছে জীবন।

বন্যার পানি নেমে গেলে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার লড়াই শুরু করেছেন কৃষক। ক্ষতি কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় তিস্তা চরের জমিতে নতুন করে ফসল চাষে নেমেছেন। চলতি বছর কয়েক দফা বন্যার পর শুস্ক মৌসুমে তিস্তার বুকে জেগে উঠেছে ধুধু বালুচর। উজানের পলি জমে অগভীর খরস্রোতা তিস্তা নদী আবাদি জমিতে রূপ নিয়েছে। এই বালু চলে লাখো কৃষক বিভিন্ন ফসল ফলিয়ে স্বপ্ন বুনছেন।

দীর্ঘদিনের তিস্তার ভাঙনে জমি খুঁইয়ে পরিবারগুলো দেশের বিভিন্ন এলাকায় চলে যায়। এখন সেই পরিবারগুলো আবার চরে ফিরে এসে বাপ-দাদার ভিটায় পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করছেন। টিকে থাকার জন্য বালিচরে ফসল চাষ শুরু করেছেন।

লালমনিরহাটের জেগে উঠা ৬৩ চরে এখন সবুজের সমারোহ। তিস্তা বুকে যেন সবুজের হাতছানি। তিস্তার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চরগুলোতে জমি তৈরি, বীজ বপন,পরিচর্যা বা ফসল ঘরে তোলার কাজে ব্যস্ত কৃষক। এ চরাঞ্চলে কৃষিকাজ অনেকটাই এখন নারী শ্রমিকদের দখলে। তাদের কর্মমুখর শ্রমের বিনিময়ে অনেক পরিবারই সাবলম্বী হয়ে উঠছে। চরাঞ্চলেই এবার ভুট্টাসহ কয়েকটি ফসলের ফলন হয়েছে বাম্পার। আর চিরাচরিত কয়েকটি ফসল ছাড়াও যোগ হয়েছে একাধিক নতুন সবজির চাষ।

চরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এ অঞ্চলের বৃহৎ নদী তিস্তা এখন মরুভূমি। বালুচরে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন কৃষক। আলু, ভুট্টা, মরিচ, মুশুর ডাল, মিষ্টি কুমড়া, চীনা বাদাম, পেঁয়াজ, রসুন,তরমুজসহ বিভিন্ন ফসল চাষের ধুম পড়েছে তিস্তায়। কথা হয় হাতিবান্ধা উপজেলার সিন্দুর্না ইউনিয়নের দক্ষিণ সিন্দুর্না গ্রামের কেবার উদ্দিনের (৭০) সঙ্গে। তিনি বলেন, তিস্তায় নদীতে ৯ বার ঘরবাড়ি হারিয়ে বর্তমানে অন্যের জমিতে বাড়ি করে আছি। 

এবারও দুই বিঘা আবাদি জমি তিস্তায় বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমানে নদীর পানি না থাকায় জেগে উঠা চরে শেষ সম্বল আড়াই বিঘা জমিতে আবাদ শুরু করি। এর মধ্যে ৪০ শতকে ভুট্টা, এক বিঘাতে পেঁয়াজ ও মরিচ চাষ শুরু করেছি। আশা করি, ভালো ফসল পাব। চরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ফিরে দেখা গেছে ফসলের নজরকাড়া দৃশ্য।

লালমনিরহাট জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ছোট-বড় অনেকগুলো নদী। কিন্তু কালক্রমে নদী ভরাট হয়ে পানি শুকিয়ে মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে এ জেলার জনপদ। বন্ধ হয়ে গেছে নদীকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য, চাষাবাদ। আর পানি না থাকায় দুর্দিন চলছে মৎস্যজীবীদের। তিস্তা, ধরলা, রতনাই, স্বর্ণামতী, সানিয়াজান, সাঁকোয়া, মালদহ, ত্রিমোহিনী, সতী, গিরিধারী, ছিনাকাটা, ধলাই, ভেটেশ্বরসহ ছোট-বড় ১৩টি নদী লালমনিরহাট জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, যার দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে চার শত কিলোমিটার।

এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, নদীগুলো পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে। জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ১৩টি নদী ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে এগুলোতে কোনো পানি নেই। নদীগুলো খনন করে পানিপ্রবাহ ধরে রাখা সম্ভব। এ ব্যাপারে সরকারের সদিচ্ছা প্রয়োজন বলে মনে করেন পাউবোর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্প সূত্র জানায়, বর্তমানে তিস্তায় পানি রয়েছে সাড়ে ৩ হাজার কিউসেক। প্রকল্প এলাকায় সেচ দেওয়া এবং নদীর প্রবাহ ঠিক রাখতে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে প্রয়োজন ২০ হাজার কিউসেক পানি।

ফসলের পরিচর্যায় ব্যস্ত কৃষক-কিষাণী শুধু সেচ প্রকল্প চালাতেই প্রবাহমাত্রা থাকা প্রয়োজন ১৪ হাজার কিউসেক এবং নদীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য চার হাজার কিউসেক পানি। কিন্তু তিস্তায় প্রয়োজনীয় পানি মিলছে না। শুষ্ক মৌসুমে বোরো আবাদের সময় ব্যারাজ পয়েন্টে কয়েক বছর ধরে পাওয়া যায় মাত্র ৫০০ কিউসেক পানি। ব্যারাজের সবকটি জলকপাট বন্ধ রেখে সেচ প্রকল্পে পানি সরবরাহ করায় নদীর ভাটিতে আর প্রবাহ থাকছে না।

পানি উন্নয়ন বোর্ড ডালিয়া নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম, তিস্তার পানি প্রবাহ ধরে রাখার চেষ্টা করছি। উজান থেকে পানি কম আসায় এবার সেচযোগ্য জমির আওতা কমানো হচ্ছে তবে শুষ্ক মৌসুমে ১৫ হাজার কিউসেক পানি পাওয়া গেলে প্রকল্পটি তার লক্ষ্য পূরণ করতে পারত। হাতীবান্ধা উপজেলার চর সিন্দুর্না গ্রামের মহাসিন আলী বলেন, তিস্তার চরে ৫ বিঘা জমিতে ভুট্টা,আলু,মরিচ চাষ করছি। ক্ষেতে পানির অভাব দেখা দিয়েছে। তাই নিরুপায় হয়ে শ্যালো মেশিন দিয়ে সেচ দিতে হচ্ছে।

হলদি বাড়ি গ্রামের আনোয়ার হোসেন জানান, এবার ভুট্টা,আলু বীজ ও সার উচ্চ মূল্যে কিনে চাষ আবাদ করছি। জানি না দাম পাব কিনা। সানিয়াজান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর বলেন, গেল বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করা হয়েছে। তিস্তার চরে চাষ আবাদের জন্য অনেক কৃষক বিনামূল্যে ভুট্টা বীজ ও সার পেয়েছেন। আশা করি, পরিবারগুলো চাষবাস করে ঘুরে দাঁড়াবে। 

এদিকে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলায় রবি মৌসুমে কৃষি প্রণোদনা ও পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে বিনা মূল্যে সার ও বীজ বিতরণ করা হয়েছে।এ সময় ৮ হাজার ৬শত ১৫ জন প্রান্তিক কৃষকের মাঝে বিভিন্ন ধরনের বীজ ও সার দেওয়া হয়।

লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক বিধু ভূষণ রায় জানান, কয়েক দফা বন্যার পর তিস্তার চরাঞ্চল এখন আবাদি জমিতে পরিণত হয়েছে। চরাঞ্চলের মাটিতে পলি জমে থাকার কারণে অনেক উর্বর। সে কারণে রাসায়নিক সার ছাড়াই বিভিন্ন ফসলের ফলন ভালো হচ্ছে। বিশেষ করে চরাঞ্চলে ভুট্টা, গম, আলু, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, চীনাবাদাম, তরমুজ, সরিষা, তিল, তিশিসহ শাক-সবজি এবং নানা জাতের ধান চাষ বেশি হচ্ছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ