‘৬/৭ জনকে বাঁচিয়েছি, তবও আমার মেয়েটিকে বাঁচাতে পারলাম না’

ডেস্ক রিপোর্টঃ
রাজধানীর ইস্কাটনে দিলু রোডের ছয়তলা বাসায় আগুন লাগার পর কয়েকজন বাদে পুরো বাড়ির সব ফ্ল্যাটের অধিকাংশ লোকজন ছাদে উঠে যান। ৪৫/ এ নম্বর বাড়ির ছাদ থেকে ঝুঁকি নিয়ে পেছনের একটি বাড়ির ছাদে গিয়ে আশ্রয় নেন তারা। অগ্নিকাণ্ডের শিকার হওয়ার বাড়িটির ষষ্ঠ তলার ভাড়াটিয়া জাহাঙ্গীর আলম নিজে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অন্যদের এক ছাদ থেকে অন্য ছাদে পাঠিয়েছেন। সবার শেষে পার হয়েছেন তিনি। নিজে অন্যদের জীবন বাঁচাতে পারলেও কলেজ পড়ুয়া মেয়ের জীবন বাঁচাতে পারেননি। ছাদ থেকে লাফ দিতে গিয়ে পা ভেঙেছে জাহাঙ্গীর আলমের। ভাঙা পা নিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) মর্গে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘ছয়-সাতজনকে বাঁচাইছি, আমার মেয়েকে বাঁচাতে পারলাম না’। 

বুধবার দিবাগত রাত ৪ টার দিকে বাড়ির নিচতলায় আগুন লাগার পর লোকজনের চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘর থেকে স্ত্রী-মেয়েসহ বেরিয়ে আসেন জাহাঙ্গীর আলম। আগুনের প্রখরতা দেখে বাবা-মায়ের নিষেধ উপেক্ষা করে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে যান জাহাঙ্গীর আলমের ভিকারুন নিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ পড়ুয়া মেয়ে আফরিন জান্নাত জ্যোতি (১৭)। আর ফিরে আসতে পারেননি জ্যোতি।

এদিকে, মেয়ে নিচে নেমে গেলেও তাকে না পেয়ে অন্য প্রতিবেশীদের সঙ্গে নিয়ে স্ত্রীসহ ছাদে যান জাহাঙ্গীর। এরপর একে একে ওই বাড়ির সব লোকজনকে নিরাপদে পাশের বাসার ছাদে পাঠিয়ে দেন। সবার শেষে পার হন জাহাঙ্গীর আলম। তবে পাশের নিচু ছাদটিতে লাফানোর সময় শরীরের ভারসাম্য ঠিক রাখতে না পারায় পা ভেঙে যায় তার। সব লোকজন বাড়ি থেকে নেমে আসার পর মেয়েকে আর খুঁজে পাননি জাহাঙ্গীর আলম। ভাঙা পায়ের চিকিৎসা করাতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আনা হয় তাকে। সেখানে এসে জানতে পারেন ওই ভবনে আগুনে পুড়ে তিনজন মারা গেছেন। দুজনের পরিচয় পাওয়া গেলেও একজন নারীর পরিচয় পাওয়া যায়নি। এ খবর শুনে ওই অবস্থায় ছুটে যান ঢাকা মেডিক্যাল মর্গে। পুড়ে যাওয়া লাশ দেখে শনাক্ত করেন ওই নারী তারই মেয়ে জ্যোতি। বাড়ির ষষ্ঠ তলা থেকে তৃতীয় তলা পর্যন্ত নামতে পেরেছিলেন ভিকারুন নিসা নূনের এই ছাত্রী। তৃতীয় তলা থেকে তার লাশ উদ্ধার করে মর্গে পাঠিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। 

দিলু রোডের ওই বাড়িতে লাগা আগুনে আরও দু’জন মারা গেছেন। তারা হচ্ছেন আব্দুল কাদের লিটন (৪৫) ও শিশু এ কে এম রুশদী(৫)। বাড়ির বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লিটন থাকতেন নিচতলায়, গ্যারেজের পেছনের একটি কক্ষে। আর রুশদী তার বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকতো তৃতীয় তলায়। আগুনে রুশদীর বাবা-মা দুজনই দগ্ধ হয়েছেন। রুশদীর বাবা শহীদুল ইসলামের (৪০) শরীরের ৪৩ শতাংশ পুড়ে গেছে। আর মা জান্নাতুল ফেরদৌসের (৩৫) শরীরের ৯৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। দুজনই ঢামেকের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাদের বাড়ি নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলার ইটনা গ্রামে। শিশু রুশদীর লাশ শনাক্ত করেন তার দাদা এ কে এম শহিদুল্লাহ।

বাড়িতে আগুন লাগার পর সবার আগে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসেন কেয়ারটেকার লুৎফর রহমান। তিনি বলেন, আগুনে গ্যারেজের বিভিন্ন অংশ পোড়ার শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়। আগুন বেশি দেখে আমি বাইরে বের হয়ে আসি। চিৎকার করে অন্যদের নিচে নামতে না করি। তিন চারজন সিঁড়ি দিয়ে নেমে বের হয়েছে। বাকিরা কেউ নিচ দিয়ে বের হতে পারেননি। তারা ছাদ দিয়ে পেছনের বাসায় গেছে। আর কিছু মানুষ বাড়ির গ্রিল বেয়ে রশি ধরে নিচে নেমেছে। 

বাড়ির কিছু বাসিন্দা ও প্রত্যক্ষদর্শী প্রতিবেশীরা জানান, আগুন চারতলা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ায় ছাদ থেকে অনেকে দড়ি বেয়ে অন্যপাশ দিয়ে নিচে নেমে আসেন। ছয়তলার ছাদে আশ্রয় নিয়েছিলেন রোকসানা পারভিন পারুল। সঙ্গে ছিল দুই মাসের শিশু সন্তান। শিশুকে অন্য একজনের মাধ্যমে পাশের বাসার ছাদে পার করে দেন। কোলে করে পার করা সম্ভব ছিল না। ছাদ থেকে পাশের বাসার ছাদে আরেকজনে কোলে ছুড়ে দেওয়ার সময় শিশু সন্তান মাথায় আঘাত পেয়েছে। তার স্বামী শাহাবুদ্দিন শিহাব ছাদ থেকে লাফ দিতে গিয়ে পায়ে আঘাত পেয়েছেন। 

রোকসানা পারভিন পারুল বলেন, আগুনের তাপ এত বেশি ছিল যে, ছাদে দাঁড়ানো যাচ্ছিলো না। ছাদে ট্যাংকি থেকে পানি দিয়ে শরীর ভিজিয়ে রেখেছি। শেষ পর্যন্ত আমি একাই ছাদে ছিলাম। পাশের ছাদে যেতে পারছিলাম না। পরে ফায়ার সার্ভিস এসে আমাকে উদ্ধার করেছে।

ভোর সাড়ে ৪টার দিকে ওই ভবনের নিচতলায় গ্যারেজ থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ৯টি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে ভোর সাড়ে ৫টার দিকে আগুন নির্বাপন করে। এ ঘটনায় তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। পাশাপাশি পুড়ে গেছে গ্যারেজে থাকা সাতটি গাড়ি। এরমধ্যে পাঁচটি প্রাইভেট কার ও দুটি মোটরসাইকেল রয়েছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। বাড়ির চতুর্থ তলা পর্যন্ত আগুন ছড়িয়েছিল বলে জানিয়েছেন বাসিন্দারা।

প্রাথমিকভাবে শর্টসার্কিট থেকে আগুন সূত্রপাত হয়েছে বলে ধারণা করা হলেও প্রকৃত কারণ জানতে উপ-পরিচালক আবুল হোসেনকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস। আবুল হোসেন বলেন, আমরা এখনও সঠিক কারণ বলার মতো অবস্থায় পৌঁছাতে পারিনি। দ্রুত সময়ের মধ্যে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট জানানো হবে।

এদিকে নিহতদের ময়নাতদন্ত শেষে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলে জানিয়েছেন ঢামেক পুলিশ বক্সের ইনচার্জ পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া। তিনি বলেন, দুজনের মরদেহ শনাক্ত হয়েছে। অপর একজনের পুরো শরীর পুড়ে গেছে। যে কারণে দেখে বোঝার উপায় নেই। তবে একজন তার মেয়ে বলে দাবি করেছেন। আর কোনও দাবিদার না থাকায় আমরা ময়নাতদন্ত শেষে তার মরদেহও পরিবারের কাছে হস্তান্তর করবো।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ