সাঁথিয়ায় অনাহারে তাঁত শ্রমিক

রাজিবুল করিম রোমিও, পাবনা জেলা প্রতিনিধি:
করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে সরকারি নির্দেশে পাবনার সাঁথিয়ায় বন্ধ রয়েছে সকল তাঁতের কারখানা। তাঁতপল্লীতে এখন বিরাজ করছে সুনশান নিরবতা, নিস্তদ্ধতা। ফলে দুর্ভোগে পড়েছে হাজার হাজার তাঁত শ্রমিকসহ মালিকগণ। এক নাগারে বন্ধের কারণে তাঁতীদের অর্ধাহারে,অনাহারে দিন যাপন করতে হচ্ছে। সরকারি সহযোগিতা না পেলে ধংসের মুখে পতিত হবে পাবনার তাঁত শিল্প এমনটাই মনে করছেন তাঁত ব্যবসায়ীরা। তাঁতিরা জানান, মহামারি করোনার কারণে কারখানা বন্ধ ঘোষণার ২২দিন পার হলেও এখন পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি কোন ত্রাণ সহায়তা পাননি তারা। অপরদিকে হাট-বাজার বন্ধ থাাকায় উৎপাদিত পণ্যর পাহাড় জমে গেলেও বিক্রি করতে পারছেন না তারা। তাঁত মালিকেরা বলেন, অবস্থায় নিজেরাই চলতে পারছি না শ্রমিকদের দেব কি। কয়দিনই বা চালানো যায়। এমনিতেই সংকটের মধ্যে চলছিল তাঁত ব্যবসা, তার উপর করোনা মহামারিতে বন্ধ ঘোষনাণায় আরও লোকসানে যাচ্ছে তাঁতশিল্প। অপরদিকে ব্যবসা বন্ধ হলেও ব্যাংকের ঋণের সুদ বাড়ছে হু হু করে। নিয়ে চিন্তিত রয়েছেন তাঁতীরা। সরকার যদি তাদের সহযোগিতা না করে তবে শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন তাঁতীরা। সরেজমিন উপজেলার তাঁত সমৃদ্ধ পিপুলিয়া, শশদিয়া, ফকিরপাড়া, ছেচানিয়া, করমজা, ধুলাউড়ি, ঘুঘুদহ, তেতুঁলিয়া গ্রাম ঘুরে দেখা যায় ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে যেসব তাঁতপল্লীতে খটখট শব্দে মুখরিত ছিল। হঠাৎ করোনার প্রভাবে তাঁতীপাড়া যেন সনুশান, নিস্তব্ধ নিরবতা। অথচ রমজানের আগের মাস থেকে তাঁতিদের ব্যবসার কাঙ্খিত সময়। সারা বছর ধরে তাঁতিরা এই সময়ের জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। এই সময়েই কাপড়ের সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকায় তাঁদের দম ফেলার সময় থাকে না। অথচ বছরের সবচেয়ে এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন তাঁতীরা। সাংবাদিকদের দেখে কয়েকজন শ্রমিক এগিয়ে এসে বলেন, ভাই আমরা না খেয়ে মরে যাচ্ছি। প্লিজ আমাদের জন্য কিছু করেন। আর পারছি না। সাঁথিয়ার নজরুল ইসলাম নজু নামের এক প্রবীণ তাঁত শ্রমিক জানান, আজ তিন সপ্তাহ আমাদের কোন কাজকর্ম নেই। মহাজন কাপড় বিক্রি না করলে টাকা দিতে পারবে না। ঘরে খাবার নেই, পরিবার পরিজন নিয়ে চলতে পারছি না। আজ প্রায় মাস হতে চললো কারও থেকে কোন সহায়তাও পাইনি। পিপুলিয়া গ্রামের হাফিজুল, আব্দুল্লাহ সহ প্রায় ১০জন তাঁতশ্রমিক জানান, প্রতি সপ্তাহে যে টাকা বিল পেতাম তা দিয়ে কোনভাবে পরিবার নিয়ে কোনমতে কেটে যেত। তাঁত বন্ধ থাকায় আজ সপ্তাহ কোন বিল পাই না। কোন কাজকর্ম নেই। ঘরেও কোন খাবার নেই, বাজার নেই কার কাছে বলবো। কি যে কষ্টে আছি তা আল্লাহ জানেন। বাংলাদেশ তাঁতবোর্ড সূত্রে জানা যায়, পাবনার সাঁথিয়া বেসিক সেন্টারের অধিনে প্রায় ৩৫ হাজার তাঁত রয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় লক্ষাধিক শ্রমিক কাজ করছে এখানে। এখানকার বেশিরভাগ কারখানাগুলো ব্যাংকের ঋণ নিয়ে ব্যবসা করে আসছে। মহামারি করোনা রোধে ক্রমাগত বন্ধের কারণে একদিকে যেমন তারা বেকার হয়ে পড়েছে অপরদিকে খাদ্যাভাবে তাদের অর্ধাহারে, অনাহারে দিন কাটছে। পর্যন্ত সরকারি কোন প্রকার ত্রাণ সহায়তা আসেনি। তবে তালিকা প্রস্তুত চলছে বলে জানান তাঁত বোর্ডের এক কর্মচারি। সাঁথিয়ার খ্যাতনামা তাঁতব্যবসায়ী হালাল লুঙ্গির প্রোপাইটর আলহাজ্ব ইন্তাজ আলী মল্লিক বলেন, আমার প্রায় শতাধিক তাঁত রয়েছে। এখানে নারী পুরুষ মিলে প্রায় আড়াইশ শ্রমিক কাজ করে। আজ প্রায় এক মাস হতে চলল কারখানা বন্ধ রয়েছে। হাটবাজারও বন্ধ। উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে না পেরে ব্যাংক থেকে মোটা অংকের ঋণের কিস্তি দিতে পারছি না। প্রতি সপ্তাহে রিকভারি দিতে হয়। কিন্তু দিতে পারছিনা। দিকে কারখানা বন্ধ থাকলেও সুদতো বেড়েই চলছে। কিভাবে সুদের টাকা দেব তা আল্লাহ জানেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নিকট ঋণের সুদ মওকুফের আবেদন জানান। পিপুলিয়া গ্রামের তাঁতী দেলোয়ার হেসেন জানান, বাড়িঘর, জমিজমা বন্ধক রেখে ব্যাংক বিভিন্ন এনজিও থেকে ১৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ৪০টি তাঁত কিনে ব্যবসা শুরু করেছিলাম। তাঁতের উৎপাদিত লুঙ্গি বিক্রি করতে পারছি না। ব্যাংকের কিস্তির টাকা দিতে পারছিনা। তাঁত না চললেও সুদ তো বেড়েই চলছে। তাঁত বিক্রি করে সুদের টাকা দেয়া ছাড়া কোন উপায় থাকবে না। ভিটেমাটি বিক্রি করে ঋণের টাকা দিতে হবে। অপরদিকে এখানে প্রায় দেড় তাঁত শ্রমিক কাজ করে। তারাও অর্ধাহারে, অনাহারে দিন যাপন করছে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আবেদন রেখে বলেন, প্রধানমন্ত্রী মানবতার মা। তিনি অবশ্যই আমাদের ধংস হতে দিবেন না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই তাঁত বোর্ড প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আজ তা ধংসের দ্বারপ্রান্তে। সাঁথিয়া বেসিক সেন্টারের লিয়াজোঁ অফিসার শ্রী জুয়েল চন্দ্র তাঁতীদের দুর্ভোগের চিত্র তুলে ধরে বলেন, তাঁতবোর্ড থেকে তালিকা চেয়েছে। আমরা সমিতির মাধ্যমে অসহায় তাঁতী তাঁতশ্রমিকের তালিকা তৈরি করছি। খুব দ্রুত এগুলো পাঠিয়ে দেব বোর্ডে। এর আগে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিকট একটি তালিকা জমা দিয়েছি। এখন পর্যন্ত কোন সাহায্য সহযোগিতা আসেনি। সাঁথিয়া পৌর মেয়রমিরাজুল ইসলাম বলেন, কয়েক তাঁতী পরিবারকে ত্রাণসহায়তা দেয়ার উদ্যাগ নেয়া হয়েছে। খুবই অল্প সময়ের মধ্যেই তা বিতরণ করবো। আর তাঁতীদের ব্যাংক ঋণের বিষয়ে সুদ মওকুফের জন্য সরকারের নিকট সুপারিশ করবো। উপজেলা নির্বাহী অফিসার এসএম জামাল আহম্মেদ জানান, সরকারের পক্ষ থেকে যে ত্রাণ এসেছিল তা বিভিন্ন উপজেলায় চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে অসহায়দের মাঝে বন্টন করা হচ্ছে। ত্রাণ অপর্যাপ্ত থাকায় সবাইকে দেয়া সম্ভব হয়নি। আবার আসবে। এলে পর্যায়ক্রমে সবাইকে দেয়া হবে। তাঁত মালিকদের ঋণের সুদ মওকুফের জন্য সুপারিশ করা হবে

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ