রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৫ লাখ শিশু উদ্বাস্তু শৈশবকাল পার করছে

 


বিশেষ প্রতিবেদকঃ

সরকারের সাথে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর যৌথভাবে করা সর্বশেষ জনসংখ্যা বিবরণী (ফ্যাক্টশিট)'র তথ্যানুযায়ী দেশের ৩৪ টি ক্যাম্পে আশ্রিত  রোহিঙ্গার মোট সংখ্যা ৯,২৬,৪৮৬ জন।

সম্প্রতি (১২ জুন) প্রকাশিত বিবরণীতে বলা হয়,  মোট রোহিঙ্গা জনসংখ্যার ৫২ শতাংশই শিশু। যার মধ্যে ০-১ বছর বয়সী ১৭,১৮৬ জন, ১-৪ বছর বয়সী ১,২৫,৫২৮ জন, ৫-১১ বছর বয়সী ২,০৩,৭২৭ জন এবং ১,৩৪,০৯৯ জন ১২-১৭ বছর বয়সী শিশু।

অর্থাৎ এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২ লাখ ৩৪ হাজার ১৪৪ জন মেয়ে ও ২ লাখ ৭৩ হাজার ৩৯৬ জন ছেলে সহ মোট ৫ লাখ ৭ হাজার ৫৪০ জন রোহিঙ্গা শিশু নিজ দেশ মায়ানমার নয় বরং উদ্বাস্তু হয়ে

বর্তমানে শৈশবকাল পার করছে দেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে।

এ বছরের বিশ্ব শরণার্থী দিবসের আগের দিন ১৯ জুন, রোহিঙ্গাদের "গো হোম" বা "বাড়ি চলো" ক্যাম্পেইনের অংশ হিসেবে ক্যাম্পগুলোতে আয়োজিত সমাবেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের অংশগ্রহণ ছিলো সবচেয়ে বেশি। 

তারাও অগ্রজদের মতো কন্ঠে আওয়াজ তুলেছে, "চলো চলো আরকান চলো"। কোমল হাতগুলোতে

শোভা পেয়েছে মায়ানমারের পতাকা, দাবী সম্বলিত প্লে কার্ড-পোস্টার।

উখিয়ার লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সমাবেশে হাজারো রোহিঙ্গাদের মাঝে একঝাঁক শিশুর মধ্যমণি হয়ে স্লোগান দিচ্ছিলো ১১ বছরের রোহিঙ্গা শিশু মোহাম্মদ আয়াছ।

সে মায়ানমারের মংডু থেকে মাত্র ৭ বছর বয়সে মা ও নানীর হাত ধরে ২০১৭ সালে বাংলাদেশে চলে আসে। আয়াছের বাবা নিখোঁজ হয় সহিংসতায়, পাঁচ বছরেও যার সন্ধান মেলেনি।

নিজের হাতে থাকা মায়ানমারের পতাকা দেখিয়ে আয়াছ জানায়, " এটি আমার দেশের পতাকা, আমাদের আরাকানে আমি ফিরতে চাই ।বাবাকে দেখিনা অনেক দিন, জানিনা তার দেখা আর পাবো কিনা। দেশে গেলে অন্তত বাবার স্মৃতির সাথে বাঁচবো।"

১৩ নং ক্যাম্পের সমাবেশে বক্তব্য রাখা রোহিঙ্গা যুবকদের সৃজনশীল সংগঠন রোহিঙ্গা ইয়ুথ এসোসিয়েশনের সভাপতি কিন মং বলেন , " আমাদের সমাবেশে রোহিঙ্গা যুবক কিশোর এর পাশাপাশি শিশুরাও অংশ নিয়েছে, উঠতি বয়সী শিশুরা ও এখানে জন্ম নেয়া শিশুদের অভিভাবকরা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। আমরা দ্রুতই আমাদের দেশে চলে যেতে চাই। "

কুতুপালং ১-ইস্ট ক্যাম্পের বাসিন্দা মোহাম্মদ ইয়াসিন (২৮) নামে এক রোহিঙ্গা শংকিত বাংলাদেশে জন্ম নেয়া তাঁর ৮ মাসের পুত্র ইয়ামিনের ভবিষ্যৎ নিয়ে।

তুলনামূলকভাবে শিক্ষিত এই রোহিঙ্গা তরুণ জানালেন, " ইয়ামিন এখনো ছোট, আমি জানিনা তার ভবিষ্যৎ কি হবে। সে বড় হওয়ার আগেই মর্যাদা নিয়ে আমার নিজের জন্মস্থানে ফিরে যেতে চাই, যেনো সে নিজের সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠতে পারে। " 

শরণার্থী দিবস উপলক্ষে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে গিয়ে রোহিঙ্গা শিশুদের সাথে কথা বলেন ইউএনএইচসিআর-এর শুভেচ্ছা দূত ও দেশের জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী তাহসান খান। 

পরিদর্শনে শেষে উখিয়ায় আসলে তাহসান টিটিএনকে বলেন, " আমি রোহিঙ্গা শিশুদের সাথে কথা বলে তাদের মাঝে নিজ দেশের জাতীয়তাবোধ উপলব্ধি করেছি। তারা জানে তাদেরও নিজস্ব জাতীয় সংগীত আছে, ভাষা আছে।"

তাহসান জানান, " তারা দ্রুত দেশে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। কিন্তু তাদের মৌলিক অধিকার এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা পর্যন্ত একই ঘটনা পুনরায় ঘটতে পারে বলে ভয়ও পাচ্ছে।"

এদিকে, বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে প্রায় চার লক্ষ স্কুল-বয়সী রোহিঙ্গা শিশু রয়েছে বলে গত ১মে প্রকাশিত নিজেদের ওয়েবসাইটের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে ইউনিসেফ। 

শিশুদের নিয়ে কাজ করা জাতিসংঘের এই সংস্থাটি ইতিমধ্যে রোহিঙ্গা শিশুদের তাদের নিজ দেশের পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে পাঠদান দিতে কক্সবাজারের ক্যাম্প গুলোতে শুরু করেছে মিয়ানমার কারিকুলাম পাইলট (এমসিপি) প্রকল্প। ২০২২ সালের মে মাসে ১০ হাজার শিশু প্রাথমিকভাবে এই কার্যক্রমের আওতায় এসেছে।

স্বেচ্ছায়, নিরাপদে এবং মর্যাদার সাথে যদি রোহিঙ্গা শিশুদের মায়ানমারে ফিরে যাবার পরিবেশ সৃষ্টি হয়, তবে পরীক্ষামূলক এই কার্যক্রম মায়ানমারের শিক্ষাব্যবস্থা ও সমাজের সাথে তাদের একীভূত হবার সুযোগ সৃষ্টিতে সহায়তা করবে বলে প্রতিবেদনে জানায় ইউনিসেফ ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ