
দীর্ঘ ৪ বছর একই শাখায় বহাল তবিয়তে
* ক্ষমতার প্রভাব কাজে লাগিয়ে স্ত্রীকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বিএডিসিতে নিয়োগ
* মিরপুরে আড়াই কোটি মূল্যের ২ টি ফ্ল্যাট ক্রয়
বাংলাদেশ সচিবালয়ের কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. মুনসুর রহমান দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মচারী। আওয়ামীলীগ আমলে নিজেকে পরিচয় দিতেন শ্রমিক লীগের নেতা হিসেবে। দীর্ঘ চার বছরের অধিক সময় ধরে তিনি কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন-২ শাখায় বহাল তবিয়তে দায়িত্ব পালন করছেন। অথচ নিয়ম অনুযায়ী একই শাখায় এত বছর একটানা থাকার কোনো নজির নেই। মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন-২ শাখাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এখান থেকেই মন্ত্রণালয়ের সব ধরনের কেনাকাটার কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে মুনসুর রহমান এই শাখায় পদায়ন পান। এরপর থেকে তিনি নিজেকে আওয়ামী ঘরানার লোক পরিচয় দিয়ে দাপটের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। ওই সময়ে মন্ত্রণালয়ের সাবেক কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তারের প্রত্যক্ষ প্রভাবে মুনসুর প্রশাসন-২ শাখায় দীর্ঘ সময় একই পদে অবস্থান করতে সক্ষম হন। এই ওয়াহিদা আক্তারের সরাসরি নেতৃত্বে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউতে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মিছিল বের করেছিলেন।
শুধু কেনাকাটায় নয়, মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ-বাণিজ্যেও এগিয়ে এই মুনসুর। নিজের স্ত্রীকে ক্ষমতার ব্যবহার করে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থা বিএডিসিতে (বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন) ব্যক্তিগত কর্মকর্তা পদে চাকরি দিয়েছেন এবং স্ত্রীকে মতিঝিলে হেড অফিসে পোস্টিং এর ব্যবস্থাও করেন তিনি। এ ছাড়া অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ আয় ও সম্পদের হিসাবেও তথ্য গোপনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
মুনসুর প্রশাসন-২ শাখায় আসার পর থেকে ভুয়া বিল-ভাউচার তৈরি, নিজের পছন্দের লোকদের টেন্ডার প্রদান এবং টাকার বিনিময়ে মানহীন পণ্য সরবরাহ করতেন। টেন্ডার ও আরএফকিউ প্রক্রিয়ায় বছরের পর বছর একক নিয়ন্ত্রণে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় এসব জানার পরও অনিয়মের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী মুখ খোলার সাহস পাননি। এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী।
অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করলে মুনসুর বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ আনা হয়েছে সব মিথ্যে, আমাকে হয়রানি করার জন্য এসব করা হচ্ছে।’
তবে আওয়ামী সরকার উৎখাতের পর পরিস্থিতি পালটে যায়, মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী বর্তমান কৃষি সচিব ড. এমদাদ উল্লাহ মিয়ানের কাছে মুনসুরের নানা দুর্নীতির বিষয়ে অভিযোগ করেন। তদন্তে এসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার পর চলতি বছরের ৬ আগস্ট তাকে অন্য শাখায় বদলির নির্দেশ দেন সচিব। তবে বদলির আদেশ আমান্য করে একমাস ধরে পদে বহাল ছিলেন তিনি, পরে গণমাধ্যমে বিষয়টি জানাজানি হলে তিনি ৭ সেপ্টেম্বর বদলি শাখায় চলে যান।
অভিযোগ উঠেছে, প্রশাসন-২ শাখার ডেস্ক অফিসার উপসচিব ড. হাতেম আলী এবং প্রশাসন অধিশাখার যুগ্মসচিব মো. এনামুল হকের সহযোগিতায় তিনি পুরোনো পদে বহাল ছিলেন। এতে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা- কর্মচারীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়।
সূত্র জানায়, যুগ্মসচিব এনামুল হক একসময় সাবেক অর্থমন্ত্রী এএইচএম মুস্তফা কামালের পিএস ছিলেন এবং বিভিন্ন জেলায় ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। অপরদিকে উপসচিব হাতেম আলীর স্ত্রী এনএসআইয়ের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, যার সঙ্গে সাবেক কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, ওয়াহিদা আক্তারের আস্থাভাজন হিসেবেই এনামুল হক ও হাতেম আলীকে কৃষি মন্ত্রণালয়ে পদায়ন করা হয়েছিলো । তাঁদের ছত্রছায়ায় থেকেই মুনসুর রহমান এখনও বদলির আদেশ অমান্য করে প্রশাসন-২ শাখায় বহাল আছেন। জানা যায়, কয়েক কোটি টাকার ক্রয় বাণিজ্য সামাল দিতে মুনসুরকে এই পদে বহাল রাখতে তৎপর ছিলেন এই দুই কর্তা।
এদিকে অনুসন্ধানে মুনসুরের অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়টি সামনে এসেছে, দ্বিতীয় শ্রেণির একজন কর্মচারী হয়েও রাজধানীর মিরপুর ১৩ নম্বরে ওপেক্স গার্মেন্টস লিমিটেডের পাশের একটি বহুতল ভবনে আড়াই কোটি টাকা মূল্যের দুটি ফ্ল্যাটের মালিক তিনি। সরকারি চাকরি থেকে প্রাপ্ত বেতনের সঙ্গে এই বিপুল সম্পদ ক্রয়ের কোনো সামঞ্জস্য নেই।
এমন ব্যাপারে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব হাতেম আলী বলেন, ‘ যদি কেউ কোন অনিয়মের সাথে জড়িত থাকে মন্ত্রণালয় অবশ্যই ব্যবস্থা নিবে।’ মুনসুরে বদলি বিষয়ে কথা হলে তিনি বলেন, চলমান কাজগুলো শেষ করার জন্য বদলি আদেশ কার্যকর হতে সময় লেগেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মচারী জানিয়েছেন, মুনসুর রহমান অনেক অনিয়মের সাথে জড়িত। তাঁর এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে বিগত আওয়ামী আমলে যারা প্রতিবাদ করেছে তাদের তিনি বিভিন্নভাবে হয়রানি করেছেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যোগসাজশ তিনি বেপোরোয়া হয়ে গেছে। পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) তদন্তে নামার দাবি তুলেছেন তাঁরা।


0 মন্তব্যসমূহ